নিজের রুমে বসে আছি হঠাৎই রান্নাঘরে আমার ভাবী আমার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-শোনো! তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ এভাবে অন্যের উপর বসে বসে খাওয়ার কারণে। তোমার স্বামীতো কিছু করেইনা উল্টো সারাদিন বখাটে ছেলেপেলেদের মতো টই টই করে ঘুরে বেড়ায়। আর কত দিন এভাবে খাবে? আমার স্বামীতো আর তোমাদের জন্য বস্তা ভরে কামাই করে না তাইনাহ? তুমি তোমার স্বামীকে বুঝিয়ে বলবা একটু। জায়গা জমির ভাগ পেয়েছে বলেই যে অন্যের কামাই খাবে এটা কেমন কথা? তোমরা আলাদা হয়ে যাও নয়তো আমরাই আলাদা হয়ে যাবো। বুঝছো?
ভাবীর এমন কথায় রাইসা বেশ ইতোস্তত ভঙ্গিতে বললো,
-না না ভাবী! আপনারা কেন আলাদা হবেন? বড় ভাইয়া সেই তরুণ বয়স থেকে এই বাড়ির প্রতিটি মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে দেখে এসেছে। সেই হিসেবে আপনারাই এই বাড়ির উপযুক্ত অংশীদার। আপনি একদম চিন্তা করবেন না, আমি আপনার দেবরকে অচিরেই একটি চাকরী না হোক অন্ততঃপক্ষে একটি কাজ হলেও করতে বলবো। আর আমারও লজ্জা হয় এভাবে অন্যের উপর বসে বসে খেতে। চিন্তা করবেন না কিছুদিনের মধ্যেই আমরা আলাদা হয়ে যাবো।
ভাবী কিছুটা নাক শিটকানো ভঙ্গিতেই বললেন,
-হুম তাই যেন হয়।
.
আমি এই ঘর থেকে তাঁদের কথোপকথন শুনে আমার মনের মধ্যে প্রবল জেদ চেপে বসলেও সেটা বাহিরে প্রকাশ করার আর সাহস পেলাম না। কারণ এমনিতে ভাবীতো ঠিকই বলেছেন যে আমি কোনো কাজ করিনা তবে একটি চাকরীর জন্য যে কম চেষ্টা করে যাচ্ছি তাও কিন্তু মিথ্যে নয়। তাছাড়া এভাবে প্রতিনিয়ত আমার স্ত্রীর অপমানিত হওয়াতে আমার মনেও বারবার কড়া নাড়ে।
ভাবীর কাছ থেকে এমন অপমানজনক কথা শুনে প্রত্যেক মেয়েরই তাঁর স্বামীর প্রতি ভয়ঙ্কর রাগ ঝাড়ার কথা ছিল কিন্তু অবাক করা বিষয় হল রাইসা রান্নাঘর থেকে আমাদের রুমে এসে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গোসলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার মনে হল এতক্ষণ যাবৎ ও ভাবীর মুখ থেকে যেই কথাগুলো শুনলো সেগুলো সে গায়েই মাখেনি। নিরবতা ভেঙ্গে আমি বললাম,
-ভাবী কি বললো তোমাকে?
রাইসা জানে ভাবীর সমস্ত কথাই আমি শুনেছি তবুও সে আলনার কাপড়গুলো গোছাতে গোছাতে বললো,
-কি আর বলবে? প্রতিদিন যা বলে সেটাই বলেছে।
-তোমার খারাপ লাগেনা এসব শুনলে?
-লাগে মাঝেমধ্যে তবে স্বামীর অসহায়ত্বটাও তো দেখতে হবে তাইনাহ? তুমিতো চাকরির জন্য চেষ্টা করছোই, যদি না করতে তবে বেশি খারাপ লাগতো।
মেয়েটির এমন কথায় আমি ওর মুখের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকি এবং প্রতিবারই মনে হয় প্রভু হয়তো ওকে এক্সট্রা কোনো উপকরণ দিয়েই তৈরি করেছেন। রাইসার মতো এতোটা ধৈর্য্যশীল মেয়ে বাস্তব জীবনে আমি খুব কমই দেখেছি।
.
আমি তখন সবে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন আমার শিশুকালেই আর সেই থেকেই আমার বড় ভাই আমাদের মা ছেলের এই ছোট্ট সংসারের হাল ধরেছিলেন।
আমার মা যখন মুমূর্ষু অবস্থায় বিছানায় পরেছিলেন তখনই তিনি বড় ভাইয়ের কাছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত আবদার করে বসেন। মায়ের ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর আগে আমার বিয়ে দেখে যাওয়া কিন্তু অমন ছাত্রাবস্থাতে এই যুগে বিয়ে করাটা স্বাভাবিকভাবেই সমাজের শিক্ষিত মানুষের নিকট চোখে বিঁধে যাওয়া কাঁটা বৈকি কিছু নয়। তবুও আমার হাজারো অনিচ্ছাসত্ত্বেও বড় ভাইয়া অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাইসার মতো এমন নমনীয় মনের অধিকারী মেয়েকে আমার বউ বানিয়ে আনেন। যদিও কোনো পরিবারই এমন অপরিপক্ব অনার্স পড়ুয়া ছেলের কাছে নিজেদের মেয়েকে সমর্পণ করতে চাননি কিন্তু আমার স্ত্রীর বাবা না থাকায় ওর পরিবার অনেকটা সুযোগ সন্ধানীর মতোই নিজেদের মেয়েকে এবাড়িতে বউ রূপে পাঠিয়ে দেন।
আমার মা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমাদের প্রতি ভাবীর হিংসা বিদ্বেষ ক্রমেই বাড়তে থাকে। কারণ একেতো আমি কোনো কাজ করিনা এরমধ্যে আবার বড় ভাইয়ের উপর বসে বসে আমি এবং রাইসা ফ্রিতেই খাচ্ছি। স্বভাবতই এগুলো কোনো নারীই মেনে নিবে না সেখানে ভাবীর কথাতো বাদই দিলাম।
.
রাতে আমি আর রাইসা নিজেদের রুমে বসে গল্পগুজব করছি হঠাৎই ভাইয়ার রুম থেকে চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ শুনে দুজনেই কানটা একটু খাঁড়া করলাম। যতটুকু বুঝতে পারলাম যে ভাবী আমাদের ব্যপারেই ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করছে। একপর্যায়ে ভাইয়া ঝগড়ার মাঝেই ভাবীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। অবস্থা ক্রমেই বেগতিক হচ্ছে দেখে আমরা আর একমুহূর্ত দেরী না করে তাঁদের রুমে পাড়ি জমাই। আমাদের দেখে ভাবীর রাগের মাত্রাটা বোধহয় আরো একটু বাড়লো। তিনি অনেকটা আক্রোশ কন্ঠেই আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে ভাইয়াকে বললেন,
-তোমার ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের প্রতি যখন এতোই দরদ উতলিয়ে পরছে তবে তাঁদের নিয়েই তুমি এবাড়িতে থাকো। আমি কালই বাপের বাড়িতে চলে যাবো।
এই বলেই যখন তিনি রুম থেকে বের হতে যাবেন তখনই রাইসা তাঁর হাত ধরে থামাতে গিয়েও ব্যর্থ হল। তিনি অনেকটা ঝাড়ি দিয়েই রাইসার হাতটি ছুটিয়ে হনহন করে বের হয়ে গেলেন।
এমন পরিস্থিতি দেখে আমি ভাইয়াকে শান্ত স্বরে বলে উঠলাম,
-ভাইয়া, আমি একটা কাজ পেয়েছি। কালই রাইসাকে নিয়ে অন্যত্র পাড়ি জমাবো। তুমি আর চিন্তা করোনা এসব নিয়ে।
-ধুর কি বলিস! তোর ভাবীর কথায় কি সবকিছু হবে নাকি। এই বাড়িতে আমার যেমন অংশীদারিত্ব আছে তেমনি তোরও আছে। তুই এখানেই থাকবি ও যা বলার বলুক।
-থাক, আমরা চাইনা আমাদের কারণে তোমাদের মধ্যে কোনো অশান্তির সৃষ্টি হোক। আর এই বাড়িতে আমার অংশীদারিত্ব আছে সেটা আমি অস্বীকার করছি না তবে তুমি এই পর্যন্ত আমাদেরকে যেভাবে নিঃস্বার্থভাবে দেখে এসেছো সেই তুলনায় এই বাড়িতে তোমাদের থাকার যৌক্তিকতাটুকুই বেশি। আমরাতো মাঝেমধ্যেই বেড়াতে আসবো। তুমি একদম চিন্তা করবেনা আমাদের নিয়ে।
সেদিন ভাইয়াকে অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বললেও পরবর্তীতে বাড়ি ছেড়ে চলের আসার পর বাস্তবতার কাঠিন্যতার মাঝে ভালোই আটকে গিয়েছিলাম। একজন শিক্ষিত ছেলের সিএনজি চালানোটা যে কতটা অপমানজনক ছিল সেটা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারতাম। তবুও কোনো কাজই অসম্মানের নয় এই ধারণা মনে পুঁষে রেখে এবং আমার স্ত্রী এই অসহায়ত্বের মাঝেও আমার পাশে থাকায় নিজের মনে এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করতাম। তবে এতোকিছুর মাঝেও আমাদের সংসারে সুখের কোনো কমতি ছিল না। একটা সময় প্রভুর কল্যাণে আমি বেশ ভালো বেতনের একটি চাকরিও পেয়ে যাই। সেদিন আমার মনে হয়েছিল ভালো কিছু পেতে হলে অবশ্যই পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।
.
অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি হঠাৎই ভাইয়ার নাম্বার থেকে কল আসলো। রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে আমার ভাবী বলে উঠলেন,
-তুমি তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলে চলে আসো। তোমার ভাইয়া এ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। প্লিজ তাড়াতাড়ি আসো।
ভাবীর কথা শুনে আমি অনেকটা নাওয়া খাওয়া ভুলেই আমার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে রওয়ানা দেই।
শেষপর্যন্ত অজস্র চেষ্টা করার পরেও ভাইয়াকে বাঁচাতে পারিনি। ভাইয়ার এভাবে অকাল মৃত্যুতে স্বভাবতই আমার কষ্টের মাত্রাটা বেশ তীক্ষ্ণই ছিল বটে। আমার স্ত্রীও যে একমাত্র ভাসুরের এমন মৃত্যুতে কষ্ট লোপণ করেনি তাও কিন্তু নয়। ভাবী বারবারই অতি শোকে মূর্ছা যাচ্ছিলেন আর আমার দুই ভাতিজিও বাবার এমন মৃত্যুতে কাঁদতে কাঁদতে চোখের অবশিষ্ট জলটুকুও খুইয়ে ফেলেছিল।
.
ভাইয়ার মৃত্যুর দুইমাস চলে গেছে এমনকি এখন পরিস্থিতিটাও বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আজ রাতে যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিবো ঠিক তখনি রাইসা আমাকে বলে উঠলো,
-শোনো, ভাবী আজ কল দিয়েছিল।
-কেনো?
-না মানে সিমুর স্কুলের কয়েকমাসের বেতন নাকি বকেয়া রয়ে গেছে। ওর বেতন না দিলে নাকি স্যারেরা পরীক্ষা দিতে দিবেনা তাই তোমার কাছে কিছু টাকা চেয়েছিল ধার হিসেবে।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
-কাল বিকাশে পাঠিয়ে দিও।
.
এর কিছুদিন পর হঠাৎই এক অচেনা নাম্বার থেকে আমার ভাতিজি আমাকে ফোন দিয়ে বললো,
-চাচ্চু! এক লোক আমাদের বাসার সবকিছু নিয়ে যেতে এসেছে। ঐ লোক নাকি আম্মুর কাছে টাকা পেত, তুমি তাড়াতাড়ি আসো।
ভাতিজির ফোন পেয়ে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না বরং তৎক্ষনাৎ রাইসাকে নিয়ে সেখানে রওয়ানা দিলাম। উপস্থিত হতেই দেখতে পাই ভাবী সেই লোকের নিকট অজস্র আকুতি মিনতি করছে কিন্তু লোকটি কোনোভাবেই তাঁর কথা না শুনে কিছু লোক নিয়ে ঘরের দামি দামি আসবাবপত্র গুলো বস্তায় ভরছে। আমি এমন কান্ড দেখে এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে বললাম,
-ঐ মিয়া আর একটা জিনিসে যদি হাত লাগে তাহলে খবর আছে। সবগুলো জায়গা মতো রাখেন। কতটাকা পাবেন বলেন?
-দশ হাজার।
-ওকে এই নেন। আর সবকিছু জায়গা মতো রেখে এখনি বাসা থেকে বের হন।
অতঃপর লোকটি চলে যেতেই ভাবী কান্নায় রাইসার উপর ঢলে পরলেন। পরক্ষণেই কান্নামাখা স্বরে বললেন,
-তোমরা যদি আজ না আসতে তবে আমার যা সম্মান ছিল তার সাথে সাথে ঘরের মালামালও ওরা নিয়ে যেত।
-আচ্ছা! আমি থাকতে আপনি ওদের থেকে টাকা ধার নিতে গেলেন কেন? আমি কি মরে গিয়েছি নাকি?
-তোমার কাছে আর কত টাকা ধার চাইবো বলো। তোমাদেরকে আমি এতবার অপমান করার পরও তোমরা কিছু মনে না করে আমাকে টাকা ধার দিয়েছিলে। আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা। আমি আজ সত্যিই এই দুটো মেয়েকে নিয়ে অসহায়।
রাইসা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
-ভাবী! বড় ভাইয়া আমাদের যে কতটা সাহায্য করেছিল সেটা আমরা ভুলে যাইনি। আর আপনার দেবর আপনাকে কোনো টাকা ধার দেয়নি বরং এগুলো নিজের দায়িত্ববোধ থেকে এমনিতেই দিয়েছে আর ভবিষ্যতেও দিয়ে যাবে।
রাইসার কথায় আমি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলাম না। কারণ মেয়েটি এমনই যে কখনোই নিজের মনে কোনো প্রতিশোধের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে না। আমার যদিও ভাবীর মতো এমন অহংকারী মহিলার দায়িত্ব গ্রহণের ব্যপারে কোনো ইচ্ছাই ছিল না তবে আমার এমন নমনীয় হৃদয়ের অধিকারী স্ত্রীর সিদ্ধান্ত আদৌ আমার পক্ষে রিজেক্ট করা সম্ভব নহে। সত্যিই এমন হিংসা বিদ্বেষহীন মনের অধিকারী মেয়ে সমাজে খুব কমই আছে। তবে এই কথাও চিরন্তন সত্য যে সময় সবার সবসময় এক যায়না। একটা সময় ভাবী আমাদের অপমান করে বাড়িছাড়া করেছিল আর আজ তিনিই কিনা আমাদের উপর নির্ভরশীল। ইহা সত্যিই প্রভুর এক অদ্ভুত লীলাখেলাই বটে।
.
.
*অদ্ভুত লীলাখেলা
.
সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে
Misk Al Maruf