রাঢ় বাংলার মানব সংস্কৃতি
#শিবানন্দ_পাল
মেদিনীপুরে (অবিভক্ত) কংসাবতীর তীরে সিজুয়ার প্রত্নক্ষেত্রে সেই কোন হোলোসিন যুগে প্রাগৈতিহাসিক হোমো স্যাপিয়েন্স তরুণ, একটি অ্যাশিউলিউ হাত কুঠার নিয়ে পশু শিকারের উদ্দেশ্যে জলাভূমিতে নেমেছিল। বয়স যার ১৭ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে। কিন্তু নিজেই শিকারে পরিণত হয়। এইরকম একটি ছবি আমরা কল্পনা করতে পারি। কংসাবতীর নদী চত্বরে প্রাপ্ত প্রত্নাশ্মীয় হাতিয়ার আমাদের এই গল্প বলে।
দামোদর উপত্যকার বীরভানপুরে
অনুকূল আবহাওয়া থাকায় গড়ে উঠেছিল
শালের গভীর জঙ্গল। শ্যামল শোভা সেই ধরনের জঙ্গল সাধারণত গোষ্ঠী জীবনের সহায়ক। কিন্তু সেই হোলোসিন যুগে
স্থানীয় মানুষের জীবনচর্যা প্রধানত মৃগয়াভিত্তিক হলেও, কৃষিভিত্তিক সমষ্টি জীবন গড়ে উঠেছিল কিনা স্পষ্ট জানা যায় না। বিজ্ঞানীদের কিছুটা সংশয় আছে। যে সংশয় পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে নেই।
পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে ঘরবাড়ি, মানুষের সমাধি, হাতে চিপে চিপে তৈরি করা মাটির বাসনের সঙ্গে কুমোরের চাকায় নির্মিত মাটির বাসনপত্র পাওয়া গেছে। এমনকি পোড়ামাটির মৃৎপাত্রে রঙের কারুকাজ করা হয়েছে। মৃৎপাত্রের গায়ে ধান ও ধানের খোসা বা ধানের শিসের ছাপ পাওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ইকনমিক বোটানিস্ট বিজ্ঞানী এ কে পাল পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, এই ধান ওরিজা স্যাটিভা "Oryza Sativa L. Graminae" প্রজাতির।
পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে প্রথম যুগের অধিবসতির উপর সাদা এবং হলুদ বালির স্তরে চাপা পড়ে থাকায় বিজ্ঞানীদের ধারণা এখানকার অধিবসতি পরিত্যক্ত হয়নি। অতীতের কোনো প্লাবনে এরকম হতে পারে। সেই প্লাবনের পর হয়তো দীর্ঘদিন, সেটা এক বা একাধিক শতাব্দীও হতে পারে সেখানে আর কোনও গ্রাম সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। আবার সেই যুগে এই অঞ্চলে বালু ঝড়ের প্রাবল্য ছিল।
আরও অনেক দিন পর পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে দ্বিতীয় অধিবসতির যুগ শুরু হয়। এই পর্বে দেখা যায় তাম্রশ্মীয় সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে । এই সময়ের মৃৎপাত্রগুলো আরও সুন্দর হয়েছে। তাতে এসেছে অলংকরণের ছাপ। যা তৎকালীন মিশর, ক্রিট দ্বীপ, এশিয়া মাইনর, ইরান, তুরান, চিন এবং ভারতের অন্যান্য জায়গার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আবার এই সময়ের কারুকার্যময় মৃৎশিল্পের সৌন্দর্য, মানুষের সৌখীন জীবনচর্যার কথা বলে। এই সময়ে তৈরি এখানকার পারফোরেটেড পটারি যা সিন্ধু সভ্যতার কথা মনে করিয়ে দেয়। তামার স্পাইরাল চুড়ি, কাজলকাঠি স্মরণ করিয়ে দেয় ফারাওদের যুগের মিশর কুমারীদের কথা। পাওয়া গেছে হাড়ের তৈরি বর্শাফলক ও তীরের ফলা। সূক্ষ্ম এবং ধারালো হাড় বা মৃগশৃঙ্গে নির্মিত এগুলির সঙ্গে ছিল, তরুণ জলহস্তীর কয়েসের দাঁতে তৈরি বাঘনখ কিংবা মাদুলির মতো একটি অলংকার। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্লিস্টোসিন পর্বের পর ভারতে জলহস্তী বিলুপ্ত হয়, আর পাওয়া যায় না। জলহস্তীর বর্তমান বাসভূমি আফ্রিকা এবং সংলগ্ন দেশ মাদাগাস্কার। তাহলে হোলোসিন যুগে রাঢ়বঙ্গে এই দাঁত এলো কিভাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর গবেষকদের খোজা উচিত।
ওই দাঁত যে জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল, তার ঠিক নীচে প্রথম যুগের স্তরে পাওয়া যায় তেরো বছরের অনূর্ধ্ব দুটি নাবালক কিংবা নাবালিকা হবে হয়তো, এবং তিনটে পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ মানুষের মৃতদেহের অবশেষ। পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে দ্বিতীয় যুগের সংস্কৃতি যে উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল সন্দেহ নাই। মোরামপেটা ঘরের মেঝেতে পাওয়া গেছে শিমুল তুলোর বোনা সাদা কাপড়ের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অংশ অথবা সিল্কের কাপড়ের টুকরো। পাওয়া গেছে পোড়ামাটির চক্রাকৃতি তকলি। যার উপর খোদাই করা কয়েকটি রেখা বা আঁচড়। শিল্পশৈলীর পরিচয়। প্রাগৈতিহাসিক ট্রয় বা আনাতোলিয়ায় এরকম মাটির তৈরি গোলাকার তকলি পাওয়া গেছে। যার গায়েও এরকম উৎকীর্ণ নকশা কাজের দেখা পাওয়া গেছে। কি করে এই সাদৃশ্য এলো ভাবায়। পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে মোট ১৪টা মানুষের সমাধি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬টা প্রথম যুগের, ৮টা দ্বিতীয় যুগের। বোঝা গেছে প্রাথমিক পর্যায়ে মৃতদেহগুলো সরাসরি শোয়ানো হয়েছিল ।
দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের শেষকৃত্যে মৃতদেহ উন্মুক্ত কোনো জায়গায় অথবা অন্য কোন অবস্থায় রাখার পর, তার কঙ্কালগুলো মাটির কলসিতে পুরে সমাধিস্থ করা হয়েছে। মৃতদেহ সমাধি দেওয়ার এইরকম রীতি প্রথম ও দ্বিতীয় যুগে একইরকম। সময়ের পার্থক্য থাকলেও ট্রাডিশন ভোলেনি। এসব ভাবনা মনের মধ্যে অনেক প্রশ্নের তৈরি হয়। আবার মৃতদেহগুলোর মাথা রাখা হয়েছে পূর্ব দিকে, পাগুলো পশ্চিম দিকে। ইংরাজিতে যাকে বলে 'ইস্ট-ওয়েস্ট ওরিয়েন্টেসন'। পূর্ব পশ্চিম দিক জ্ঞান, তাহলে সেই জনগোষ্ঠীর মাথায় এসেছিল? দেহগুলো রাখার ব্যাপারটাও অদ্ভুত! প্রথম যুগের কঙ্কালগুলো মুণ্ডহীন। দ্বিতীয় যুগের একটি কঙ্কালের পায়ের পাতা কাটা। দুর্ঘটনার শিকার হলেও হতে পারে। কিন্তু মৃতদেহ কখনও প্রসারিত অবস্থায় (এক্সটেন্ডেড) রাখা হয়েছে, আবার কখনও সঙ্কুচিত দশায় (ফ্লেক্সড)। এরকম কেন করা হলো? একই জায়গায় দ্বিতীয় পর্বের কঙ্কাল প্রসারিত অবস্থায় রাখা হয়েছে, অন্য কতগুলো সমাধির সঙ্গে। কঙ্কালের মাথা আর পায়ের দিকে রাখা হয়েছে দেহাবশেষের টুকরো ভরা দুটো বড় কলসি। পূর্ব দিকের কলসিতে হাড়ের সংখ্যা বেশি, ঢাকা দেওয়া ছিল লাল কালো রঙের বড়ো একটা গামলা দিয়ে। প্রসারিত শোয়ানো কঙ্কালের শরীরে রাখা ছিল দুটো পুঁতি, একটি তামার অন্যটা অ্যাগেট পাথরের। ভারতীয় নৃতত্ত্ব সর্বেক্ষণের দুজন বিশেষজ্ঞ পবিত্র গুপ্ত, অনাদি পাল সেগুলো পরীক্ষা করে বলেন শায়িত কঙ্কাল ৩০ বছর কিংবা তদূর্ধের কোন পুরুষের। সাড়ে ন'ফুট গভীর একটি গর্তে দ্বিতীয় পর্যায়ের যে সমাধি পাওয়া গেছে, সেটা একজন মহিলার। ৩০ অথবা তার বেশি বয়স হবে। বিচিত্র ধরনের এই সমাধিগুলোতে বিচিত্র ধরনের অন্ত্যেষ্টি রীতি। এক্ষেত্রেও মৃত মহিলাকে অন্য কোনো ভাবে রাখার পর তার কঙ্কালগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো একত্র করে তার উপর করোটি রাখা হয়েছে পশ্চিম দিকে মুখ করে। যেন সে নিজের হাড়গোড়ের উপর বসে, দুচোখে চেয়ে আছে পশ্চিম দিকে, হয়তো কেউ আসবে, সেই প্রতীক্ষায়। আবার তার পাশে রাখা হয়েছে লাল রঙের মাটির সছিদ্র পাত্রের ভাঙ্গা অংশ। যাকে সুললিত ভাষায় বলা হয় সছিদ্র মৃৎভাণ্ড (পারফোরেটেড পটারি)।
পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে প্রাপ্ত এইসমস্ত মানব-সমাধিগুলো পরীক্ষা করেন ভারতীয় নৃতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তদানীন্তন অধিকর্তা অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু এবং নৃবিজ্ঞানী দিলীপকুমার সেন। পরবর্তীকালে তিনি এই সংস্থার অধিকর্তা হয়েছিলেন। সংস্থার বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ পবিত্র গুপ্ত এবং অনাদি পাল একের পর এক দেহাবশেষগুলো বের করেন। ওঁদের সহযোগিতা করেছিলেন নৃবিজ্ঞানী বিমল দত্ত। পবিত্র গুপ্ত এবং অনাদি পাল দুই নৃবিজ্ঞানী দেহাবশেষগুলো স্টাডি করেন। তাঁদের বক্তব্য প্রকাশ করেন, "Bulletin of the Anthropology Survey of India. Vol. XIX,Nos. 3 & 4."-তে। "Human Skeletal Materials Excavated At Pandu Rajar Dhibi"। in Bulletin of the Anthropology Survey of India. Vol. XIX,Nos. 3 & 4.
প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রভূত তর্কবিতর্কের মধ্যে ঐক্যমতের ভিত্তিতে বলা যায়, রাঢ় বঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির সবচেয়ে পুরনো ইতিহাসের খোঁজ মিলেছে দামোদর উপত্যকার বর্ধমান (পশ্চিম) জেলার বীরভানপুরে। যা ৪০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ সময়ের। পূর্ব বর্ধমান জেলার পাণ্ডুরাজার ঢিবির প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় যুগের প্রাচীনত্ব স্থির করা হয়েছে ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ সময়ের।
মনে করা হয় কুনুর নদীর তীরে বর্ধমান (পূর্ব) জেলার বসন্তপুর; কুনুর-অজয় নদীর তীরে রাভারডাঙ্গা, মঙ্গলকোট; খড়ি ও মায়া নদীর তীরে মণ্ডল গ্রাম; ভাগীরথী তীরে গঙ্গা ডাঙ্গা; ভাগীরথী ও বেহুলা নদীর তীরে হাতিপোতার ডাঙ্গা সংলগ্ন এলাকার এবং বর্ধমানের ধনটিকরার সংস্কৃতি পাণ্ডুরাজার ঢিবির সমসাময়িক অর্থাৎ ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ সময়ের শেষের দিকের।
বীরভূমের কোপাই নদীর তীরে মহিষদলের প্রথম ও দ্বিতীয় যুগের সংস্কৃতির প্রাচীনত্ব থাকলেও সময় নির্ণিত করা সম্ভব হয়নি। বীরভূমের কোপাই ও ময়ূরাক্ষীর উপকূলে পোতাণ্ডা, নানুর-এর সংস্কৃতি পাণ্ডুরাজার ঢিবির সমসাময়িক ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ সময়ের শেষের দিকের বলে মনে করা হয়। বীরভূমে অজয় নদের তীরে পুরসরাজার ঢিবি, মন্দিরা, হাড়াইপুর; বক্রেশ্বর নদীর তীরে যশপুর এবং বেলুনটি সরস্বতী তলা ইত্যাদি জায়গার সংস্কৃতি পাণ্ডুরাজার ঢিবির সমসাময়িক ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ সময়ের শেষের দিকের বলে মনে করা হয়।
মেদিনীপুর জেলার কংসাবতী নদীর উপত্যকায় সিজুয়ার সংস্কৃতি পাণ্ডুরাজার ঢিবির সমসাময়িক ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ সময়ের শেষের দিকের বলে মনে করা হয়। রূপনারায়ণের তীরে তমলুকের সংস্কৃতি প্রাক মৌর্য ১০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ সময়ের।
রাঢ়বঙ্গের ভূখণ্ডে এই সমস্ত জায়গাগুলোর অবস্থান অভিমুখ নির্দিষ্ট করে প্রাচীন সময়ে মানবগোষ্ঠী ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে ক্রমশ গাঙ্গেয় সমভূমির দিকে নেমে এসেছিল। প্রত্নবিজ্ঞানী পরেশচন্দ্র দাশগুপ্তের "সুবর্ণরেখার প্রাঙ্গণে অরণ্যকন্যা কংসাবতী" বইয়ে পরেশচন্দ্র পুত্র দেবপ্রিয় দাশগুপ্ত একটি সুন্দর ম্যাপ এঁকে বোঝাতে চেয়েছেন, রাঢ় বাংলার মানব সংস্কৃতি কিভাবে ধাবিত হয়েছিল নিম্নবঙ্গে গাঙ্গেয় সমভূমির দিকে।
ছবি: দেবপ্রিয় দাশগুপ্ত কৃত ম্যাপের ছবি।
তথ্যসূত্র:
সুবর্ণরেখার প্রাঙ্গণে অরণ্যকন্যা কংসাবতী, পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত। অণিমা প্রকাশনী, কলকাতা। ২০০৭।
"Human Skeletal Materials Excavated At Pandu Rajar Dhibi" in Bulletin of the Anthropology Survey of India. Vol. XIX,Nos. 3 & 4.