-"স্যার আমার আপনাকে ভালো লাগে খুব।"
সটান বলে বসলো আমার ছাত্রী রুবি, শুনে অবাক হলাম আমি। রুবি আমার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী যেমন চঞ্চল তেমন অবাধ্য, কিন্তু মেয়েটা মেধাবী সেটা জানতাম। তবে হঠাৎ করে এমন কথা সে বলে বসবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার মেসবাড়ির একটা ঘরে টিউশন পড়িয়ে আমি নিজের লেখাপড়া চালাই আর গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাই। রুবি যে বড় বাড়ির মেয়ে তা জানি, ওর বাবা লেখাপড়া নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসেন মাঝেমাঝে দুঃখ করে বলেন মেয়েটার ছেলেমানুষি আর গেল না, সিরিয়াস নয় ফিউচার নিয়ে। রুবি যে সত্যিই ছেলেমানুষ তা আবার প্রমাণ হল মেয়েটা আমার চেয়ে কতো ছোট, অবুঝ না হলে কেউ চাকরি জোটাতে না পারা গরীব টিউশন মাষ্টারকে ভালো লাগার কথা বলে? আমি রুবিকে ধমকের সুরে বললাম -"এসব কি ধরনের কথা? আর এরকম যেনো না শুনি। না হলে তোমার বাবাকে সবটা জানাবো।"
দেখলাম রুবির চোখটা জলে ভরে গেল, হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বেরিয়ে গেল সে। বাকি ছাত্রছাত্রীরা আগেই রেরিয়ে গেছিল তাই জানাজানি হল না ব্যাপারটা। মেয়েটাকে কাঁদতে থেকে খারাপ লাগলো, আমি বুঝি এই বয়সে এমন অনেক কিছু মনে হয়, ভালো লাগা ভালোবাসা হয় তারপর বাস্তব বুঝতে শিখলে ও নিজেই বুঝে যাবে ও ভুল করেছিল। রাতে শুয়ে রুবির মুখটা ভেসে উঠলো, ওর বলা কথাটা কানে বাজছিল আপনাকে ভালো লাগে স্যার। মনে মনে ভাবলাম কদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে। আমার নিজের ছয় বছরের সম্পর্ক ভেঙে গেল প্রেমিকা কারো স্ত্রী হয়ে গেল একটা সরকারি চাকরি জোটাতে পারিনি বলে, আর বাচ্ছা মেয়েটা কতো বোকা!
ভালো নাম্বার পেয়ে মাষ্টার্স পাশ করে, জমানো টাকা সব শেষ করে বি এড করেও আমি টিউশন মাষ্টার। আমি বাড়ির বড় ছেলে, বেকার বড় ছেলে। পরীক্ষায় পাশ করেও চাকরি হয় না কেস হয়ে যায়, কতোবার ইন্টারভিউতে আটকে গেছি। শেষ বয়সে এসে বাবা মাকে বলতে শুনি মরার আগে তাদের সুখশান্তি স্বাচ্ছন্দ্য কিছুই দিতে পারিনি, এতো লেখাপড়া শিখিয়ে কোনো লাভ হয়নি সত্যিই আমি অপারগ বটে। প্রেমিকা বড় অস্থির ছিল আমার সরকারি চাকরি নিয়ে, বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করার পর বাবার ঠিক করা চাকুরিজীবী ছেলের সাথে ঘর বেঁধেছে। আমার চোখের জল অসহায়ত্ব কিছুই চোখে পড়েনি তার। এরপর বয়স বেড়েছে টিউশন মাষ্টার উপাধি পাওয়ার পর আর কেউ ভালোলাগা ভালোবাসার কথা বলেনি, আমারও কাউকে নিয়ে এই ধরনের কিছু ভাবতে মন চায়নি। বাড়িতে অবশ্য বলেছে গ্রামের কোনো মেয়েকে বিয়ে করে চাষের কাজ শুরু করতে। আমি তা শুনিনি নিজের লক্ষ্য পূরণের শেষ চেষ্টাটুকু ছাড়তে নারাজ ছিলাম আমি, আর ঠিক করেছিলাম বিয়েই করবো না। ভালোবেসে দেখেছি ভালোবাসার চেয়ে প্রফেশনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর এটাও ঠিক কারো বাবা মা ই চাইবে না নিজের মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে। তবে রুবি ব্যাতিক্রম ছিল, যেটাকে আমি ছেলেমানুষি ভেবে ভুল করেছিলাম।
কিছুদিনের মধ্যেই রুবির মধ্যে অনেকগুলো পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম, আগের চেয়ে অনেক শান্ত লাগে ওকে। পড়া ঠিকঠাক করে আনে, আগের মতো ওর খাতায় ছবি এঁকে বোঝানোর জন্য হুটোপুটি করে না। চুপচাপ নিজের সাইকেল নিয়ে পড়তে আসে নির্দিষ্ট সময়ে, আগের মতো আর দেরি করে না। সত্যি বলতে ওর এই চেঞ্জটা আমার ভালো লাগেনি ওকে প্রাণবন্ত অবস্থায় বেশি ভালো লাগতো। একদিন রাত বারোটায় রুবির কল পেলাম বললো -"শুভ জন্মদিন, আপনি বারণ করেছেন বলে আর কিছু বলি না কিন্তু আমার আপনাকে ভালো লাগে।" আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না, বাইরে কে একজন বলে উঠলো-" দাদা পার্সেল আছে।"
বাইরে বেরিয়ে একটা বক্স পেলাম তাতে ছিল একটা সুন্দর কেক আর একগুচ্ছ লাল গোলাপ। সাথে মোড়ানো কাগজটা খুলতেই দেখলাম একটা স্কেচ, আমার ছবি। কি সুন্দর, আমি যখন পড়াই সেই মূহুর্তের একটা ছবি এঁকেছে রুবি। কতোটা ভালোভাবে দেখলে আর দক্ষতা থাকলে যে এমন ভাবে আঁকা যায় তা ভাবতেই অবাক হলাম। আজ বহু বছর পর আমাকে আমার জন্মদিনটা মনে করিয়ে দিল কেউ, ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। কেকটা খুলে দেখলাম আমার পছন্দের ফ্লেভারের, পাগলিটা কিভাবে জানলো কি জানিজানি! কেকটা একটু খেয়ে তুলে রাখলাম পরের দিন স্টুডেন্টদের দেবো বলে।
এরপর পড়ানোর সময় প্রায় দেখতাম রুবি আমাকে দেখছে, চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে যেতো। আমিও ওর মিষ্টি ফর্সা মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাবতাম কি দেখে আমাকে ভালো লাগলো ওর! আর বুঝতাম ধীরে ধীরে আমিও ওর মায়ায় জড়িয়ে পড়ছি, একটু একটু করে আমার মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে রুবি আমার শত চাওয়াতেও আটকাতে পারলাম না মনকে। এইভাবে আরও একটা বছর কেটে গেল সেদিন রুবিদের ব্যাচের লাস্ট ক্লাস ছিল। মনটা বিষাদে ভরে ছিল আমার, দেখলাম রুবির চোখ ছলছল করছে। শেষ ক্লাসে পরীক্ষার যাবতীয় প্রশ্ন বুঝিয়ে শেষ করলাম ক্লাস, দেখলাম রুবি শুধু আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একে একে সবাই বাড়ি চলে গেল, সেদিন রাতে ঘুম এলো না আর চোখে, জেগে ভাবছিলাম অনেক কিছু। হঠাৎ বেজে উঠলো ফোনটা, তাকিয়ে দেখলাম রুবির কল।
-"আপনি আমাকে ভুলে যাবেন তাই না?"
-"ভুলে তো তুমি যাবে, লেখাপড়ার চাপ আরো বাড়বে। তবে তোমার ছেলেমানুষি গুলোকে মিস করবো।"
-"আচ্ছা কাউকে ভালোবাসা কি অন্যায়?"
-"মোটেই তা নয়, কিন্তু কাকে ভালোবাসার কথা বলছোবলছো, সেটা ম্যাটার করে। কল্পনা আর বাস্তব এক নয়।"
-"আমি কি আপনার যোগ্য নই।"
-"না আমি তোমার যোগ্য নই, সমাজের চোখে।"
-"এমন কেনো বললেন?"
-"আমার পরিচয় কি জানো? গরীব টিউশন মাষ্টার। কারো বাড়ির লোক এমন কারো সাথে সম্পর্ক মেনে নেবে?"
-"কিন্তু ভালো থাকাটা আসল।"
-"ভালো থাকতে গেলে ভালোবাসার সাথে সামর্থ্যটাও দরকার, সামর্থ্য মানে টাকা। আমার সেটা আমার নেই।"
-"আজ নেই, ভবিষ্যতে হবে।"
-"আমার সে সম্ভবনা নেই বললেই চলে, চাকরি পাওয়ার বয়স শেষ হতে চলেছে।"
-"আমি চাকরি করলেই তো এক ব্যাপার হবে, দুজনের দিব্যি চলে যাবে।"
-"সত্যি তুমি ছেলেমানুষ, তুমি আমার দায়িত্ব নেবে?"
-"না দুজনে দুজনের দায়িত্ব নেবো। আমাকে দু বছর সময় দিন, আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবেন?"
-"দু বছরে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারবে? চাকরির বাজার যে খারাপ।"
-"চেষ্টা করবো প্রাণপণ চেষ্টা করবো, আমি আপনার সাথে থাকতে চাই।"
-"আচ্ছা তাই হোক দু বছর পর আমাদের আবার দেখা হবে, সেদিন চাকুরিজীবী হওয়ার পরেও যদি তোমার আজকের বলা কথাগুলো নর্ম্যাল মনে হয় তো আমি সানন্দে রাজি।"
দিন এগিয়ে চললো রুবির চেষ্টা দেখে মুগ্ধ হলাম আমি পাগলের মতো পড়ে মেয়েটা, মাঝে মাঝে কথা হয় আমার সাথে পড়াশোনার কোনো প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করে। একবারের জন্য আমাদের সে রাতের বলা কথা উচ্চারণ করেনি সে। একটার পর একটা পরীক্ষা পাশ করতে থাকে সে আমি ভাবি এই জগতে সত্যি এমন মানুষ ছিল! দুটো বছর কেটে গেছে গঙ্গার ঘাটে বসে আছি আমি, পাশে এসে ধপ করে বসলো রুবি। হতাশ গলায় বললো -"পারলাম না আমি।"
আমি মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম -"পারলে না বলে যে পারবে না এমনটা তো নয়, লেগে থাকতে হবে।"
-"আপনি আর আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না তাই না?"
-"ইচ্ছে তো করছে না, কিন্তু অপেক্ষা করতে হবে। কারণ তুমি চাকরি করে বেকার ছেলের দায়িত্ব নিতে চাইলেও আমি চাই স্বাবলম্বী অবস্থায় তোমাকে পেতে। আমি চাকরি পেয়েছি অনেক অপেক্ষার পর এবার তোমার টার্ন। তবে মনে হয়না খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে কারণ তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী। খুব তাড়াতাড়ি তোমার বাবার সাথে কথা বলবো দেখি উনি মেনে নেন নাকি?"
রুবি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, আমারো ওকে ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না একটুও।
এই স্বার্থের জগতে এখনো কিছু মানুষ স্বার্থহীন ভাবে ভালোবাসে, সে ভালোবাসাটা একদম খাদহীন। এরকম মানুষগুলোকে আগলে রেখে আপন করে নিতে পারলেই জীবন সুন্দর।
🫥
🖊️শ্রাবন্তী মিস্ত্রী