এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪

আমি হেলাল হাফিজ বলছি জান্নাতুল মেহেকা মুন্নী  ২৩/১২/২০২৪

 আমি হেলাল হাফিজ বলছি

জান্নাতুল মেহেকা মুন্নী 

২৩/১২/২০২৪


হেলেন, 

আমি তোমার সকল অভিযোগের পাতাগুলোকে অভিমান বলে ধরে নিলাম। 

কিন্তু আমি প্রেমিক হতে পারিনি এ অপবাদ মানতে পারলাম না। 


আমি যদি ভালো সন্তান হতাম, আমার একটি সংসার হতো।  আমার বাবা আমার যাযাবর জীবনের দুশ্চিন্তা নিয়ে পৃথিবী ছাড়তেন না। 


আমি যদি ভালো ভাই হতাম, আমার ভাইয়ের বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর জন্য একজন ভাতিজা থাকতো। তাঁকে দুর্বল একটি জীবন দিতাম না। 

আমি যদি ভালো বন্ধু হতাম আমার নিঃসঙ্গতায় জীবন যেত না! 


হেলেন, 

পৃথিবী পরাজিত প্রেমশক্তির কাছে। কিন্তু ক্ষুধার কাছে প্রেম পরাজিত এটা বোধ হয় তুমি জানো না। সেদিনের নিরবতায় তুমি ব্যর্থতা দেখলেও আমি আমাদের ভবিষ্যৎ দেখেছিলাম। একটা সংসার যেখানে অভাব আমাদের সুখ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। 

আমি একজন স্বামী যার শরীরের কোথাও, তোমার চোখে এক-ফোঁটা সম্মান নেই। 

বেকার প্রেমিকের মুখের বুলি প্রেম হলেও, 

বেকার স্বামীর প্রেম মনে হয় ছলনা। এটা বোধ হয় তুমি জানো না। 

আমি স্বামী হতে গিয়ে প্রেমিককে হত্যা করতে চাইনি বলেই, সুখের নৌকায় তুলে দিয়েছিলাম তোমাকে। অথচ আজ নির্দ্ধিধায় বলে দিলে আমি প্রেমিক হতে পারিনি! 


২৪ শে এসে তুমি বেপরোয়া একজন প্রেমিক চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি হয়তো ভুলে গেছো, আমরা ৯০ দশকের প্রেমিক প্রেমিকা। আমাদের প্রেম মানে যৌনতা না! 


তোমার প্রেমে পড়ে জগতের প্রেম, সংসারের প্রেম, বিসর্জন দিয়েছি।

তোমার প্রেমে পড়ে, যৌবনের ক্ষুধার সাথে যুদ্ধ করেছি। সঙ্গীময় জীবনের সুযোগ পেয়েও, নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিয়েছি। 


আমি প্রেমিক বলেই আমার কবিতায় তোমার স্থান দিয়েছি। 

বেঈমান হলে নির্দ্ধিধায় ভুলে যেতাম, হেলেন নামে আমার কোন প্রেমিকা ছিলো। 

আমি প্রেমিক বলেই আমার কবিতায় তোমার প্রসাংশা করেছি। 

আমি প্রেমিক বলেই তোমার শরীর ডিঙিয়ে 

হৃদয় ছুঁয়ে তোমাকে কারাগার জীবন দিয়েছি। 

পৃথিবীর কোন পুরুষের কী এ দুঃসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা ছিলো বলো? 


তুমি হয়তো জানো না, 

প্রেমিক বলেই আমার মৃত্যু হয়েছে বাথরুমে। না হলে আমার মৃত্যু হতো কোন এক রমনীর কোলের উপর মাথা দিয়ে। 

সন্তানের হাতের পানি গালে নিয়ে। 


এত ত্যাগ এত বিসর্জনের প্রতিদান হিসাবে আজ পেলাম  অপবাদের তীর। 

মানতেই হবে তুমি দারুণ প্রেমিকা, ২৪ শের প্রেমিকা, কিন্তু হেলাল হাফিজের প্রেমিকা হেলেন না।


সংস্পর্শে না থেকেও মৃত্যু পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে যে প্রেম, তাঁকে যদি তোমার প্রেমিক না মনে হয়। 

শুধু শরীর ছুঁতে না পারায় যদি প্রেমিক হিসাবে ব্যর্থ মনে হয়, তবে তুমিও প্রেমিকা হওয়ার যোগ্য না। 

হেলাল হাফিজের প্রেমিকা তো কখনোই না। 


আমি হেলেন বলছি কবিতার কাউন্টার।

মুঘল-এ-আজম সিনেমায় পরিহিত সমস্ত পোশাক দিল্লিতে সেলাই করা হয়েছিল এবং এই পোশাকগুলিতে নকশা খোদাই করা হয়েছিল সুরাটে

 #ফিল্মি_Friday

মুঘল-এ-আজম সিনেমায় পরিহিত সমস্ত পোশাক দিল্লিতে সেলাই করা হয়েছিল এবং এই পোশাকগুলিতে নকশা খোদাই করা হয়েছিল সুরাটে। হায়দ্রাবাদে গহনা তৈরি করা হয়েছিল এবং মুকুট তৈরি হয়েছিল কোলহাপুরে। একই সময়ে রাজস্থান থেকে অস্ত্র আমদানি করা হয়েছিল। কোটি টাকা খরচ করা এই ছবিতে 2000 উট ও 4000 ঘোড়া ব্যবহার করা হয়েছিল।


শীশ মহল সেটে মধুবালার সাথে শ্যুট করা 'পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া...' গানটি লিখেছেন শাকিল বন্দউনি। সঙ্গীত পরিচালক নওশাদের অনুমোদন পাওয়ার আগে এটি 105 বার লেখা হয়েছিল। এই গানটি সেই সময়ে 10 লক্ষ টাকায় শ্যুট করা হয়েছিল, যা একটি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিল।


কে. আসিফ পরিচালিত বলিউডের আইকনিক চলচ্চিত্র মুঘল-এ-আজম 1960 সালে মুক্তি পায়। বড় পর্দায় প্রেম, আনুগত্য, পরিবার এবং যুদ্ধকে দুর্দান্তভাবে চিত্রিত করা এই চলচ্চিত্রটি তৈরির পিছনের গল্পও এই ছবির মতোই বিশেষ!


আপনি কি জানেন যে, এই সিনেমাটি তৈরি করতে প্রায় 16 বছর সময় লেগেছিল!! চলচ্চিত্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল 1944 সালে এবং 1960 সালে ছবিটি মুক্তি পায়। মনে প্রশ্ন আসে কেন? এত বছর সময় লাগলো কেন?


কারণ 1947 সালে ভারত ভাগ হয়। এরপর দেশের পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয় এবং এর প্রভাব পড়ে কে. আসিফের চলচ্চিত্রে উপরও। এরই মধ্যে এই ছবির কাস্টও বদল হয় বেশ কয়েকবার। প্রথম কাস্টে আকবরের চরিত্রে চন্দ্রমোহন, সেলিম চরিত্রে ডি কে সাপ্রু এবং আনারকলির ভূমিকায় নার্গিস অভিনয় করেছিলেন। 1949 সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চন্দ্রমোহন মারা যান। এরপর প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ছবিটি আবার নতুন কাস্ট নিয়ে শুরু হয়। যেখানে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন পৃথ্বীরাজ কাপুর, দিলীপ কুমার, মধুবালা। ছবিটির বিলম্বের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।


দ্বিতীয় কারণ ছিল, এই ছবির জাঁকজমক সেট। এটি সেই সময়ে সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র ছিল, এবং এর দুর্দান্ত সেটগুলির জন্য শুটিংয়ের সময় বিশ্বের আলোচনায় পরিণত হয়েছিল। মুঘল-এ-আজম-এর শুটিং চলাকালীন, শীশ মহলের সেট তৈরি করতে প্রায় দুই বছর লেগেছিল। আসিফ জয়পুরের আমের ফোর্টের শীশ মহল থেকে এর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।


ভারতে যে রঙিন কাঁচ পাওয়া যায় তা তেমন ভালো ছিল না, তাই আসিফ এই সেটের জন্য বেলজিয়াম থেকে কাচের অর্ডার দিয়েছিলেন। খাতিজা আকবর তাঁর জীবনী 'দ্য স্টোরি অফ মধুবালা'-তে লিখেছেন, "শীশ মহলের সেট তৈরির সময় ঈদ এলো।"


মুঘল-এ-আজমের শুটিংয়ের জাঁকজমক এমন ছিল যে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এর শুটিং দেখতে আসেন। এতে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, বিখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোও ছিলেন, যিনি পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।


যাই হোক.. এত সময়, ধৈর্য এবং অর্থ ব্যয় করার পরে, এই ছবিটিও প্রচুর প্রশংসাও পেয়েছে। কে. আসিফের অনবদ্য পরিচালনা, দুর্দান্ত সেট, চমৎকার সঙ্গীতের জন্য মুঘল-এ-আজম আজও স্মরণীয়।


কেমন লাগলো আজকের #ফিল্মি_Friday এর বিষয়? কমেন্ট বক্সে আমাদের জানাতে ভুলবেন না যেন। এরকম আরও নতুন নতুন ও অজানা তথ্য জানতে হলে ফলো করুন দ্য বেটার ইন্ডিয়া বাংলা কে।


#FilmyFriday #MughalEAzam #DilipKumar #Madhubala #Bollywood #CinemaLovers #MovieLovers #ClassicMovie #BengaliNews #Bengali #Kolkata #TheBetterIndiaBangla

এত সুর আর এত গান,,,,,,

 ॥ এত সুর আর এত গান ॥


সা রে গা মা পা ধা নি — এর বাইরে কখনো সুর হয় না। আর যখন কিছু কথা এই সাত স্বরের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, ছুঁয়ে যায় আমাদের মনকে, আমরা বলি ‘গান’।


গানকে ঘিরে থাকে নানান ঘটনার ঘনঘটা। কখনো গায়ক, কখনো গীতিকার, আবার কখনো বা সুরকারের অকপট স্বীকারোক্তিতে এইসব ঘটনা সামনে আসে আমাদের। আর সেইসব গল্প নিয়েই “কিছু কথা ॥ কিছু সুর।”


আজকের গল্প সেই শিল্পীকে নিয়ে, যার গলাকে বলা হয় স্বর্ণযুগের স্বর্ণকন্ঠ। যার দাপট শুধু বাংলা আধুনিক গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, হিন্দি ছায়াছবির গানেও ছিল অসামান্য। তিনি সুবীর সেন। আজকের দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন অজানার উদ্দেশ্যে। শিল্পীর প্রয়াণ দিবসে তাঁকে নিয়েই আজ আমাদের এই বিশেষ পর্ব।


একদিন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভূপেন হাজারিকা গ্র্যান্ড হোটেলের প্রিন্সেস এ গিয়েছেন। সেখানে প্রায়ই বিদেশি ক্যাবারে আসত, ফলে নিত্যনতুন সুর পাওয়া যেত।


দুজন গিয়ে দেখলেন বিশাল বিশাল ট্রিপল কঙ্গো বাজাচ্ছেন বিদেশি কৃষ্ণাঙ্গ বাদ্যযন্ত্রীরা। ভূপেনবাবু পুলকবাবুকে বললেন — “ছন্দটা ধরে ফেলুন”। পুলকবাবু সেই ছন্দের ভাঁজে ভাঁজে কথা বসিয়ে ওখানেই লিখে ফেললেন গানটি। অনবদ্য সুর করলেন ভূপেন হাজারিকা।

গান তো তৈরি হল। এইবার প্রশ্ন, গাইবে কে?

দুজন একসাথে বললেন — “সুবীর সেন!”


তৈরি হল–

“কালো মেঘে ডম্বরু

গুরু গুরু ওই শুরু!

তবু তো ভাসাই তরী...

বিভীষিকা ঘন আধারে..

ডেকেছ তুমি যে আমারে।”


সুবীর সেনের বাড়ি এবং বেড়ে ওঠা আসামের ডিব্রুগড়ে। বাড়িতে তখন গানের একটা পরিবেশ ছিল। সেই সময় ভারতবর্ষে বসুমতী পত্রিকায় গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হত। আর এই পত্রিকা গুলো বাড়িতেও আসত। বাবা সেই স্বরলিপি দেখে গান তোলার চেষ্টা করতেন। আর মা গুনগুন করে গান গাইতেন ঘরোয়াভাবে খালি গলায়। কিন্তু এতকিছুর পরেও বাড়ির সবাই চেয়েছিলেন সুবীর সেন যেন ডাক্তার হন। কারণ বাবা ছিলেন পেশায় ডাক্তার, আর তাঁদের পারিবারিক ওষুধের ব্যবসাও ছিল। কিন্তু গান যার নেশা, তার পক্ষে কি আর ডাক্তারি পড়া সম্ভব?


ডিব্রুগড়ে একটা গানের স্কুল ছিল। পারিবারিক নানা বাধানিষেধ কাটিয়ে সুবীর সেখানে ভর্তি হলেন। সেখানেই মাঝেমধ্যে আসতেন রাগাশ্রয়ী গায়ক- পন্ডিত রতন ঝংকার। তাঁর কাছে গানের হাতেখড়ি সুবীরের। গানের পরীক্ষায় সেখানে প্রথম হলেন সুবীর সেন। তারপর ওখানেই ম্যাট্রিক পাশ করে চলে এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন আশুতোষ কলেজে। থাকতেন মামাবাড়িতে। তখন তাঁর স্বপ্নের গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তালাদ মাহমুদ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখরা। ভাবলেন এঁদের মতো গান গাইতে গেলে তো গানটা ভালো করে শিখতে হবে আগে।


প্রথমেই গেলেন চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। সেখানে কিছুদিন শেখার পর চিন্ময়বাবু সুবীর সেনকে পাঠালেন ঊষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের কাছে ঠুমরি শিখতে।


সুবীর সেন তখন নিয়ম করে প্রতি রবিবার বিখ্যাত বিখ্যাত শিল্পীদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন। এরকমই একদিন গিয়ে হাজির অনুপম ঘটকের বাড়িতে। বাড়িতে তখন অন্য অনেকের ভীড়। জায়গা না পেয়ে বসলেন ছোট্ট ডিভানের একটা কোনে। ভীড় ফাঁকা হতে অনুপম ঘটককে বললেন যে তিনি গান শিখতে চান।

অনুপম ঘটক কিছুক্ষণ সুবীরের দিকে তাকিয়ে বললেন — “তোমার গান না শুনেই বলছি, তোমার গান হবে। দেখে নিও”। 


পরে একদিন বলেছিলেন যে “যে জায়গায় সুবীর সেন অজান্তেই বসেছিলেন, সেটি ছিল গানের জায়গা। কারন সেখানেই একদিন এসে বসেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কে.এল. সায়গলের মতো দিকপালেরা।”


দূর্ভাগ্যবশতঃ অনুপম ঘটক বেশিদিন পৃথিবীতে ছিলেন না। ফলে তাঁর কাছে গান শেখাও হল না। কিন্তু তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। সুবীর সেন সত্যিকারের বড় গায়ক হয়েছিলেন।


এখন যেমন “সুপার সিঙ্গার”, “সারেগামাপা” “ইন্ডিয়ান আইডল” এর রমরমা, এতটা না হলেও পঞ্চাশের দশকেও কিন্তু ট্যালেন্ট হান্ট হত। তার মধ্যে অন্যতম সেরা ছিল HMV আয়োজিত “কেরেজু কম্পিটিশন ফর নিউ ট্যালেন্টস্”। এখানে নাম দিলেন কলেজ পড়ুয়া সুবীর সেন। প্রায় ১৪০০ প্রতিযোগীদের মধ্যে প্রথম হলেন তিনি। আর তারপর HMV-র সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি। নতুন গান বাছাই করার দায়িত্ব গায়কের। সুবীর পড়লেন মহা চিন্তায়। এর আগে বন্ধুদের সঙ্গে রেকর্ড কোম্পানিতে এসেছেন ঠিকই, রেকর্ডও করেছেন চিত্ত রায়ের সুরে, তবে সেই গানগুলো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তাহলে কি করা যায়? এইরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাজির হলেন উত্তর কলকাতার সিঁথি অঞ্চলে। ঠিকানা– 19/D গুপ্ত লেন। বাড়িটি একজন সঙ্গীত পরিচালকের।

তাঁকে গিয়ে সুবীর বাবু বললেন — “আমায় একটা ভালো গান দিন। আমি রেকর্ড করতে চাই।”


সুরকার ভদ্রলোক সব শুনে বললেন — “ভালো গান?” কিছুক্ষণ ভেবে তারপর একটা গান শোনালেন। তবে গানটা ঠিক পছন্দ হল না সুবীর সেনের। কিন্তু মুখের উপর “না” বলাও যায় না।

তাই সুবীরবাবু একটু চালাকি করে বললেন — “আচ্ছা আর একটা গান যদি শোনান....”

তখন ওই সুরকার ভদ্রলোক আরো একটা গান গাইলেন। আর সেটা শুনেই পছন্দ হয়ে গেল সুবীর সেনের।

বললেন — আমি এটাই গাইব!

কিন্তু সুরকার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আমতা আমতা করে বললেন — “মানে, আসলে, এটা তো আর একজনকে দেওয়ার কথা আছে..”

সুবীর সেন বললেন — “বেশ! ঠিক আছে। তাহলে আমি গাইব না। আমার কোনো গানই দরকার নেই।”

সুবীর সেনের এই নীরব অভিমান ছুঁয়ে গেল ওই সঙ্গীত পরিচালকের হৃদয়।

খানিক চুপ থেকে বললেন — “আচ্ছা গানটা গাও তো দেখি একবার।”

সুবীর বাবু গাইলেন।

শুনে সুরকার বললেন— “ঠিক আছে। গানটা তুমিই গাইবে।”

সেদিনের ওই সুরকার ছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। গানটি লিখেওছিলেন তিনি। আর এই একটা গানেই বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে নতুন গায়ক হিসেবে পরিচিত হলেন সুবীর সেন।

গানটি ছিল —


“ওই উজ্জ্বল দিন,

ডাকে স্বপ্ন রঙিন।

ছুটে আয় রে

লগন বয়ে যায় রে,

মিলনবীণ ওই তো তুলেছে তান

শোনো ওই আহ্বান”


১৯৫৮। গায়ক চললেন বম্বেতে। তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত ও আধুনিক গান শুনে স্বয়ং গুরু দত্ত তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সেখানে গিয়ে সুবীরের পরিচয় হল সঙ্গীত পরিচালক শঙ্কর জয়কিষান এর সঙ্গে। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। বলরাজ সাহানি, রাজেন্দ্র কুমার, শাম্মি কাপুর, মেহমুদ এর লিপে একের পর এক হিট গান উপহার দিয়ে চললেন সুবীর সেন।


আর বাংলাতেও তখন শিল্পীর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। যেমন সুদর্শন, তেমনই গানের গলা। ধীরে ধীরে ডাক আসতে লাগল অভিনয়ের জন্য। সুবীর সেনের বেশ ভালো পরিচয় ছিল ঋষিকেশ মুখার্জীর সঙ্গে। ঋষিবাবুও তাঁকে অভিনয়ের অফার দিলেন। কিন্তু সুবীরবাবু সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করলেন।

পরবর্তীকালে ওই ঋষিকেশ মুখার্জীরই অন্যতম সেরা ছবি “অভিমান” এ অমিতাভ বচ্চনের অভিনীত চরিত্রটির নাম ছিল “সুবীর কুমার”।


এইরকম নানান রঙিন ঘটনার সমাহার রয়েছে সুবীর সেনের সঙ্গীত জীবন জুড়ে।


এই বম্বেতে থাকাকালীনই তাঁর জীবনের আরও একটি সেরা গান তৈরি হয়েছিল। চলুন শোনা যাক সেই গল্প...


তখন বম্বেতে বাঙালিদের চাঁদের হাট। সুরকার, গায়ক অনেকেই। অনেকে আবার নিয়মিত বম্বে-কলকাতা করেন। বম্বেতে একই জায়গায় থাকতেন সুধীন দাশগুপ্ত ও সুবীর সেন।

একদিন সকালবেলা সুধীনবাবু বেশ গলা চড়িয়ে ডাক দিলেন— “অ্যাই সুবীর! এদিকে এসো। একটা গান লিখেছি, শোনো।”

এই বলে পড়ে শোনালেন সেই গান। গানের লিরিক্স শুনেই উচ্ছসিত সুবীর।

বললেন— দূর্দান্ত হয়েছে!

সুধীনবাবু বললেন— “গানটা তুমিই গাইবে।”

“কিন্তু সুর?”— ভ্রু কুঞ্চিত সুবীরের প্রশ্ন।

“ভাবছি..” — গালে হাত দিয়ে সুধীনবাবুর উত্তর।


পরদিন সকালেই আবার জরুরি তলব সুবীরবাবুকে। সুর হয়ে গেছে। আর তাও তিনি নিজেই করেছেন। গেয়ে শোনালেন সুবীরবাবুকে। গানটায় একটা ইংরেজি গানের ছায়া আছে। কিন্তু বাংলা কথার মোড়কে সুরকার যেভাবে সেটাকে মুড়ে নতুন রূপে উপস্থাপন করলেন, তা এককথায় অনবদ্য। রেকর্ডিং হল কলকাতায়। সুবীর সেনের গাওয়া সেরা গানগুলোর অন্যতম—


“এত সুর আর এত গান

যদি কোনদিন থেমে যায়,

সেইদিন তুমিও তো ওগো

জানি ভুলে যাবে যে আমায়...”


১৯৫৭ সালের এই গানের রেকর্ডের উল্টোপিঠে ছিল আরও একটা গান। আর সেটা নিয়েও রয়েছে গল্প–


গান লিখেছেন অনল চট্টোপাধ্যায়, আর নিজেই সুর করেও নিয়ে এসেছেন। শোনালেন সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত কে।

সুধীনবাবু শুনেই বললেন — “দারুন হয়েছে লেখাটা। কিন্তু সুর আমি করব!”

অনলবাবু বললেন — “সুর তো আমি করেই এনেছি অলরেডি।

সুধীনবাবু বললেন — “শুনুন না অনলবাবু, কথাগুলো যখন আপনি শোনাচ্ছিলেন, তখনই আমার মাথায় একটা দারুন সুর এসে গেছে। আমি সেটাই করতে চাই।”


অবশেষে ঠিক হল যে, সুধীনবাবুও ওই একই গানে সুর করবেন। তারপর যার সুরটা বেশি ভালো লাগবে, সেটাই ফাইনাল করা হবে। সুর করে নিয়ে এলেন সুধীনবাবু। সবাই শুনে বললেন সুধীনবাবুর সুরটাই থাক!

আর এভাবেই আরও একটা অন্যধরনের গান তৈরি হল —


“তোমার হাসি লুকিয়ে হাসে

চাঁদের মুখেতে..

আমার হাসি শ্রাবণ মেঘের

ধারার বুকেতে।”


বম্বেতে থাকাকালীন বিখ্যাত গায়ক-গায়িকা এবং সুরকারদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল সুবীর সেনের। এভাবেই একদিন তিনি গেছেন লতা মঙ্গেশকরের বাড়িতে। গিয়ে দেখলেন সেখানে রয়েছে লতাজীর বাবার ছবি, উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান এর ছবি, এবং এক বিদেশী কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ছবি।

সুবীরবাবু লতাজীকে জিজ্ঞেস করলেন — “ইনি কে?”

লতাজী বললেন — “ওই বিদেশী মানুষটির নাম- ন্যাট কিং কোল। অন্য অনেকের গান হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়, আর কিং কোল এর গান লোমকূপ দিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করে।”

এই বলে লতাজী কিং কোল এর একটি রেকর্ড সুবীর সেনকে দিলেন। গান শুনে অভিভূত সুবীরবাবু। তখন তিনি বেশ কিছু অনুষ্ঠানে হিন্দি ও বাংলা গানের পাশাপাশি ইংরেজি গানও গাইতেন। সুতরাং এ গানও অনায়াসেই গলায় তুলে নিলেন।

পরবর্তীকালে একটি গান রেকর্ড হয়েছিল, যার সুরকার ছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।

সেই গানের মধ্যেও ন্যাট কিং কোল এর গানের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়—


“নয় থাকলে আরো কিছুক্ষন,

নয় রাখলে হাতে দুটি হাত..

নয় ডাকলে আরো কিছু কাছে,

দ্যাখো জোছনা ভেজা এই রাত.....”


অসম্ভব সুন্দর দেখতে ছিলেন সুবীর সেন। ফলে ছবিতে হিরো হবার অফার সবসময়ই আসত তার কাছে।

একদিন উত্তমকুমার তাকে ডেকে বললেন — “অভিনয় করো না কেন?”

সুবীর সেন কি আর বলেন! একথা সেকথা বলে কাটিয়ে দিলেন।

সে যাত্রায় তো রক্ষে হল, কিন্তু এরপর হঠাৎ একদিন পরিচালক সলিল দত্ত এসে হাজির তার বাড়িতে।

বললেন — “উত্তমকুমার আমাকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন ওই ছবিতে তোমাকে অভিনয় করতে হবে। তোমার বিপরীতে নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। এবং ছবিতে ডাক্তারের ভূমিকায় স্বয়ং উত্তমকুমার।”


উত্তমকুমারের আদেশ কিকরে অগ্রাহ্য করবেন! অগত্যা রাজি হলেন। ছবির নাম – “মোমের আলো”। সেখানে প্লেব্যাক তো করলেনই, ছবিতে লিপও মেলালেন।

ছবির একটি দৃশ্যে লং ড্রাইভে গাড়িতে বসে নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য করে এই গানটি অবশ্যই এই ছবির একটা অমূল্য সম্পদ—


“ওগো কাজল নয়না...

বলো বলো,

ওগো বলো,

তুমি কি গো সেই মধুমালা

মোর শত জনমের কামনা।

ওগো কাজল নয়না...”


শুধু বাংলা ছবিই নয়, হিন্দি ছবিতেও ছোটখাটো ভুমিকায় অভিনয় করেছেন সুবীর সেন।

পরিচালক বাসু ভট্টাচার্যের হিন্দি ছবি –“অনুভব”। নায়ক সঞ্জীব কুমার, নায়িকা তনুজা। এ ছবিতেও এক উল্লেখযোগ্য মুহূর্তে তাকে দেখা গেছে গান গাইতে।

পুরো হিন্দি ছবিতে একটিই মাত্র বাংলা গান। রবীন্দ্রসঙ্গীত— 


“সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে,

ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা...”


রবীন্দ্রসঙ্গীতেও তাঁর দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা ছিল অতুলনীয়। একবার রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের হবার পর তার একটি কপি নিয়ে হাজির হলেন দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে। প্রিয় “জর্জদা” কে সেটি দিলেন শুনবার জন্য। এর দিনকয়েক পর আবারও সেখানে গেছেন। গিয়ে দেখলেন দেবব্রত বিশ্বাস গানের প্রথম লাইন শুনেই রেকর্ডের পিন টা তুলে নিচ্ছেন, আবারও চালাচ্ছেন, আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এভাবে বেশ কয়েকবার শুনলেন।

তারপরে সুবীরবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন— “কি অসাধারণ গাইসো তুমি!”

সত্যিই সেই গানটা অসাধারণ গেয়েছিলেন সুবীর সেন। 

ফাংশনে তার জনপ্রিয় গানগুলোর মাঝে এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটিও বারবার গাইতে হত তাকে—


“তুমি যে আমারে চাও...

আমি সে জানি...

কেন যে মোরে কাঁদাও

আমি সে জানি...”


গানের জগতে সুবীর সেন যখন এসেছিলেন, তখন বাংলা গানে রথী-মহারথীদের ভীড়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন রীতিমতো। সকলের মাঝে থেকেও কন্ঠমাধুর্য এবং প্রতিভার জোরে শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন সুবীর সেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে টানা সত্তরের দশক পর্যন্ত খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন তিনি। 


আজকের এই ছোট্ট প্রতিবেদনে কতটুকু আর তাঁকে ধরা সম্ভব? তবুও আজ তাঁর প্রয়াণের দিনে তাঁকে কিছুটা স্মরণ করার প্রয়াস করলাম মাত্র।

এখন এক পলকে দেখে নিই তাঁর গাওয়া কিছু গান–


চাঁদ তুমি এত আলো কোথা হতে পেলে

কথা- বঙ্কিম ঘোষ, সুর- অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।


মোনালিসা, তুমি কে বলো না

কথা ও সুর - অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।


সারাদিন তোমায় ভেবে

কথা ও সুর - অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।


সন্ধ্যালগনে স্বপ্ন মগনে

কথা- শ্যামল ঘোষ। সুর- অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।


নগর জীবন ছবির মতন

কথা - অমিয় দাশগুপ্ত। সুর - অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।


স্বর্ণঝরা সূর্যরঙে

কথা ও সুর - সুধীন দাশগুপ্ত।


ডাকলেই সাড়া দিতে নেই

কথা- পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুর- অনিল চট্টোপাধ্যায়।


চন্দন আঁকা ছোট্ট কপাল

কথা- পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুর- অনিল চট্টোপাধ্যায়।


তুমি আমার প্রেম

কথা- মিল্টু ঘোষ। সুর- অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।


আকাশ যেখানে গল্প বলে পথকে

কথা- সুনীলবরন। সুর- সুধীন দাশগুপ্ত।


তুমি বলেছিলে কোনো মনের মুক্তো

কথা- অমিয় দাশগুপ্ত। সুর- অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।

_____________________________

তথ্য সহায়তা: সারেগামা (HMV), আনন্দবাজার পত্রিকা ও অন্যান্য পত্র পত্রিকা।

প্রখ্যাত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না?"

প্রখ্যাত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না?"


শাহ আবদুল করিম বললেন, "কথা বোঝা গেলেই হইল। আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই।"


কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য আশ্চর্য হয়ে বললেন, "আপনার সৃষ্টি, আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না। এটা কোনো কথা, এটার কোনো অর্থ আছে!"


জবাবে শাহ আবদুল করিম বললেন, "তুমি তো গান গাও, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। ধরো, তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে, কিন্তু গান শুনতে কোনো মানুষ আসেনি। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে। গাইতে পারবে?" কালিকাপ্রসাদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন, "না, পারব না।"


শাহ আবদুল করিম হেসে বললেন, "আমি পারব। কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই, সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক, নাম না থাকুক, সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই৷ সেজন্যই বললাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি।"


কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য জানতে চাইলেন, "সেই আদর্শটা কী?"


শাহ আবদুল করিম আবার হেসে বললেন, "একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে।"


বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের একটি এলাকা দিরাই। সেই দিরাইয়ের উজানধল নামক গ্রামে আজ থেকে শতাধিকবর্ষ পূর্বে এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শাহ আবদুল করিম। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র আর ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন, দেখেছেন অর্থনৈতিক বৈষম্য। পরিবারের হাল ধরতে রাখাল বালকের চাকরি নেন। কিন্তু তার ছিলো গানের প্রতি, সুরের প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক। কালনী নদীর পাড়ে বসে একসময় তাই গান লিখতে আর সুরে সুরে গাইতে শুরু করেন। এভাবে গাইতে গাইতেই হয়ে ওঠেন ভাটি-বাংলার অন্যতম বাউল ও গণমানুষের কণ্ঠস্বর।


মাত্র আট দিন ব্রিটিশদের পরিচালিত নৈশ বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গুজব রটানো হলো বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। সেই আশঙ্কায় সকল ছাত্রের সাথে সাথে তিনিও ছাড়লেন বিদ্যালয়। কিন্তু নিজের চেষ্টা আর সাধনায় কাজ চালানোর মতো পড়াশোনা ঠিকই শিখেছিলেন তিনি। সেই পড়াশোনা আর জীবনের বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে রচনা করে ফেলেন প্রায় দেড় হাজার গান। যার অনেকগুলোই এখন মানুষের মুখে মুখে ফেরে।


আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক এই বাউল গানের মধ্যেও করেছেন সাম্য ও মানবাধিকারের চর্চা। পুরোপুরি নির্লোভ মানুষটি কখনো টাকার নেশায় মশগুল হননি। সারাজীবন অভাব-অনটন ও কষ্টে-সৃষ্টে কাটালেও নির্লোভ ছিলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। তার গান গেয়ে কতজন কতভাবে টাকা কামিয়েছে, কতজন তাকে কেন্দ্র করে কত ধরনের ব্যবসা করেছে, কিন্তু তিনি এসব জেনেও ছিলেন নির্বিকার। তাকে তার গানের অ্যালবাম থেকে প্রাপ্ত সোয়া তিন লাখ টাকা দেয়া হলে তিনি নিতে চাননি। বলেছিলেন, এত টাকা তার দরকার নেই, তাকে যে সম্মান দেওয়া হচ্ছে এটাই যথেষ্ট। এমন নির্লোভ মানুষ আজকাল খুঁজে পাওয়া সত্যি বিরল!


#collecte

বাংলা সিনেমার খবর ফেইসবুক থেকে নেওয়া

 রাজ্জাক-ববিতা অভিনিত-অনন্ত প্রেম ---🔹

বাংলাদেশের একটি সিনেমায় এমন একটা দৃশ্য ছিল যা পৃথিবীর আর কোনো সিনেমায় নেই। নায়ক আর নায়িকা পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। নায়কের দাড়ি শেভ করা দরকার,কিন্তু আয়না নেই। অগত্যা নায়িকার চোখের আয়নায় নায়ক দাড়ি কাটছে। নায়িকার মুখের বেশ কাছে নায়ককে ঝুঁকে আসতে হয়েছে। তাঁরা দুজনের নিঃশ্বাসের উত্তাপ অনুভব করছে। একই সিনেমায় পলাতক নায়ক পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। নায়িকা ঘুমন্ত নায়কের শিয়রে বসে গাইছে - আলো তুমি নিভে যাও …যাও… রাত আঁধার হয়ে যাও …যাও।


সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে রোমান্টিক এইসব দৃশ্য আর দেখার উপায় নেই। কারন সিনেমাটা হারিয়ে গেছে। ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটার নায়ক রাজ্জাক,নায়িকা ববিতা। এই সিনেমাতেই দেশের সিনেমার ইতিহাসে প্রথম নায়ক নায়িকার চুম্বন দৃশ্য ছিল "যদিও পরে তা বাদেই সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়" এখন সিনেমাটা খুঁজে পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো যদি কারো ব্যক্তিগত সংগ্রহে থেকে থাকে। 


অনন্ত প্রেমের গল্প ---🔹

একেবারেই নতুন ভিন্ন গল্পকাঠামো নিয়ে নির্মিত হয় "অনন্ত প্রেম" ছবিতে রাজ্জাক এবং তার তিন বন্ধু খলিল এটিএম শামসুজ্জামান ও ব্লাক আনোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ববিতাও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। খলিল ববিতাকে পছন্দ করে,কিন্তু ববিতা তাকে পাত্তা দেয় না। সে ক্ষেত্রে খলিলকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে রাজ্জাক,ব্ল্যাক আনোয়ার ও এটিএম শামসুজ্জামান। পরিকল্পনা করতে থাকে কীভাবে ববিতাকে পটানো যায়। সেই মতে নির্জন স্থানে ববিতাকে আক্রমণ করে তিন বন্ধু। আর ববিতার সাহায্যে এগিয়ে আসে খলিল। সাজানো মারামারির কারণে সবাইকে হারিয়ে ববিতার চোখে হিরো হয়ে যায় খলিল।


পরবর্তীতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ববিতাকে নির্জন জায়গায় নিয়ে ইজ্জত লুটতে চায় খলিল। চিৎকার শুনে রাজ্জাক ও বন্ধুরা এগিয়ে যায়। তবে এবার সত্যিকারের মারামারির একপর্যায়ে রাজ্জাকের হাতে খলিল খুন হয়। ববিতাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে রাজ্জাক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। ঘটনার সঙ্গে ববিতার নাম জড়ালে তার বদনাম হবে ভেবে রাজ্জাক পুলিশের কাছে বলে টাকা নিয়ে ঝগড়ার কারণে বন্ধুকে একাই খুন করেছে।


পরে পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে যায় রাজ্জাক। এ দিকে শৈশবে মাতৃহীন ববিতাকে অত্যাচার-অনাচারের অংশ হিসেবে এক লম্পটের সঙ্গে সৎমা বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ের আসর থেকে ববিতাও পালিয়ে যায়। রাজ্জাক ও ববিতা দুজনই পালিয়ে যায় দুদিক থেকে,

তবে ট্রেনে দেখা হয়ে যায় তাদের। এবার তারা পালিয়ে চলে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অরণ্যে। যেখানে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়,

শুরু হয় এক অনন্ত প্রেম কাহিনির যাত্রা। গভীর পাহাড়ি অরণ্যে ভেসে ওঠে মধুর সেই সুর - ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই,তুমি হলে মনের রানি।


এ দিকে ব্ল্যাক আনোয়ার ও এটিএম শামসুজ্জামান পুলিশের হাত থেকে পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা যায়। ফলে প্রকৃত ঘটনার সাক্ষী দেওয়ার মতো আর কেউ থাকে না। রাজ্জাকের নামে পুলিশের হুলিয়া জারি হয়,হন্য হয়ে পুলিশ খুঁজতে থাকে তাকে। একপর্যায়ে তাদের সন্ধানও পেয়ে যায়,গভীর অরণ্যের মাঝে তাদের ধাওয়া করে পুলিশ। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাবার সময় একটি ঝর্ণার কাছে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় দুজনের। মৃত্যুর সময় ভালোবাসার নির্দশন স্বরূপ পরস্পরকে চুম্বন করেন তারা। শেষ পর্যন্ত ঝর্ণার তীরে পড়ে থাকে তাদের আলিঙ্গনবদ্ধ প্রাণহীন দেহ। মূলত এটাই কালজয়ী চলচ্চিত্র "অনন্ত প্রেম" এর মূল কাহিনি৷


ছবির শেষ দৃশ্যের দিকে রাজ্জাক ববিতার একটি চুম্বন দৃশ্য ছিল,যা পরবর্তীতে বাদ দেওয়া হয়। যার একমাত্র কারণ ছিলেন ববিতা। তিনি কিছুতেই এরকম একটি দৃশ্যে অভিনয় করতে রাজি হচ্ছিলেন না,তবে রাজ্জাক সাহেব এমনভাবে বুঝিয়েছিলেন তাতে আর ববিতা দৃশ্যটি না করে থাকতে পারেননি।


তবে শুটিংয়ের পরই ববিতা আফসোস করতে থাকলেন,রীতিমত কান্নাকাটি শুরু করেন। ভাবলেন এরকম দৃশ্য দেখলে তো তাকে আর কেউ বিয়ে করবে না। ঠিক তখন রাজ্জাক সাহেব আশ্বস্ত করে ববিতাকে বললেন "আগে তুমি দৃশ্যটি দেখ,যদি ভালো না লাগে এটি বাদ দিয়ে দেবো" অবশ্য পরে ববিতা দৃশ্যটির শিল্পরূপ দেখে বাদ না দেওয়ার জন্য বলেছিলেন,কিন্তু তখন রাজ্জাক সাহেব ববিতার ভবিষ্যতের কথা ভেবে দৃশ্যটি আর রাখেননি। তিনি ভেবেছিলেন এরকম একটি দৃশ্যের জন্যে হয়তো ববিতার ভবিষ্যতের উপর কোন প্রভাব পড়তে পারে। সহশিল্পীর প্রতি এমন দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা দেখিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্জাক - ববিতারা।


তবে ছবি মুক্তির আগে এক বিবৃতিতে রাজ্জাক এটাও বলেন,আমার ছবির শেষ দৃশ্যে একটি চুম্বন দৃশ্য ছিল। পত্রিকায় সে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আমার অগণিত ভক্ত,অনেক মা-বোন ব্যক্তিগতভাবে অনেক চিঠি এবং টেলিফোনে আমার কাছে প্রশ্ন রেখেছেন যে,

চুম্বন দৃশ্যটি ছবিতে না থাকলেই কি নয়? আমি পুরো ছবিটি আবার দেখে উপলব্দি করলাম যে চুম্বন দৃশ্য না থাকলে ছবির এতটুকুও সৌন্দর্যহানি হয় না। ঐটুকু ছাড়াই এ ছবি দর্শকদের ভালো লাগবে। তাই ভক্ত এবং মা-বোনদের অনুরোধ রক্ষার্থে আমি চুম্বন দৃশ্য বাদ দিয়ে দিয়েছে।


তূমুল দর্শকপ্রিয় ছবিটির সবকটি গানও পেয়েছিল সমান জনপ্রিয়তা। সংগীত পরিচালক ছিলেন আজাদ রহমান সাহেব,অবশ্য "ঐ আকাশ যতদিন থাকবে,এই পৃথিবী যতদিন থাকবে,আমি যে তোমারই থাকবো" গানটির পরিচালক ছিলেন জনাব খন্দকার নূরুল আলম সাহেব,গীতিকার ছিলেন কাজী আজিজ আহমেদ সাহেব৷


আজাদ রহমানের সুরে_আলো তুমি নিভে নিভে যাও যাও_ঐ কোর্ট কাচারির এমনই রায়_তোমারই কাছে আমি বারবার আসবো_ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই। গানগুলো এখনো সমান জনপ্রিয় বিশেষ করে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখায় খুরশীদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমিনের কন্ঠে_ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি_গানটি সময়ের স্পর্শকে বাঁচিয়ে রেখে বাংলা চলচ্চিত্রের একটি ক্ল্যাসিক গানে পরিণত হয়েছে। গানটির শুটিং হয়েছিল কাপ্তাইয়ের অসাধারণ সুন্দর সব লোকেশনে!


লিখেছেন - আরিফুল হাসান

বাংলা মুভি ডেটাবেজ থেকে সংগ্রহ করা।

জী নজরুল সম্পর্কে যে ২০টি তথ্য আপনি না-ও জেনে থাকতে পারেন।,,,,,

 কাজী নজরুল সম্পর্কে যে ২০টি তথ্য আপনি না-ও জেনে থাকতে পারেন।


কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ছিল বিচিত্র আর বহুবর্ণিল। তাঁর সেই জীবনের কতটুকুই-বা আমরা জানি? আজ নজরুলজয়ন্তীতে নজরুল-গবেষকদের লেখা বিভিন্ন বই ও পত্রিকা ঘেঁটে এখানে বিদ্রোহী কবি-সম্পর্কিত এমন ২০টি তথ্য তুলে ধরা হলো, যেগুলো আপনি না-ও জেনে থাকতে পারেন!


🌹১. নজরুলের জীবন কোনো নিয়মের জালে আটকা ছিল না। যখন যা ভালো লাগত, তিনি তা-ই করতেন। দিন নেই, রাত নেই হই হই রব তুলে উঠে পড়তেন কোনো বন্ধুর বাড়িতে। তারপর চলত অবিরাম আড্ডা আর গান!


🌹২. নজরুলের লেখার জন্য কোনো বিশেষ পরিবেশ লাগত না। গাছতলায় বসে যেমন তিনি লিখতে পারতেন, তেমনি ঘরোয়া বৈঠকেও তাঁর ভেতর থেকে লেখা বের হয়ে আসত।


🌹৩. নজরুল ইসলাম কোনো অনুষ্ঠানে গেলে ঝলমলে রঙিন পোশাক পরতেন। কেউ তাঁকে রঙিন পোশাক পরার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, রঙিন পোশাক পরি অনেক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তথ্য দিয়েছেন, নজরুল তাঁর ঝলমলে পোশাকের ব্যাপারে বলতেন, ‘আমার সম্ভ্রান্ত হওয়ার দরকার নেই। আমার তো মানুষকে বিভ্রান্ত করবার কথা!’


🌹৪. নজরুলের পাঠাভ্যাস ছিল বহুমুখী। তিনি পবিত্র কোরআন, গীতা, বাইবেল, বেদ, ত্রিপিটক, মহাভারত, রামায়ণ যেমন পড়তেন, তেমন পড়তেন শেলি, কিটস, কার্ল মার্ক্স, ম্যাক্সিম গোর্কিসহ বিশ্বখ্যাত লেখকদের লেখা। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’-এর সব কটি গান মুখস্থ করে ফেলেছিলেন তিনি!


🌹৫. বাংলা গানে নজরুলই একমাত্র ব‌্যক্তি, যিনি সব ধরনের বিষয় নিয়ে গান লিখেছেন। তাঁর গানের সংখ্যা অনেকে চার হাজার বললেও আসলে তিনি গান লিখেছিলেন প্রায় আট হাজারের মতো, যার অধিকাংশই সংরক্ষণ করা যায়নি।


🌹৬. বাঙালি কবিদের মধ্যে নজরুলই ছিলেন সবচেয়ে বেশি রসিক। তাঁর কথায় হাসির ঢেউ উঠত। হিরণ্ময় ভট্টাচার্য ‘রসিক নজরুল’ নামে একটি বই লিখেছেন। যাঁরা বইটি পড়েননি, তাঁদের পক্ষে বোঝা কষ্টকর নজরুল কী পরিমাণ রসিক ছিলেন! একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, একবার এক ভদ্রমহিলা নজরুলকে খুব স্মার্টলি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি পানাসক্ত?’ নজরুল বললেন, ‘না, বেশ্যাসক্ত!’ কবির কথায় ভদ্রমহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। আর তক্ষুনি ব্যাখ্যা করলেন নজরুল, ‘পান একটু বেশি খাই। তাই বেশ্যাসক্ত, অর্থাৎ বেশি+আসক্ত = বেশ্যাসক্ত!’


🌹৭. নজরুলের প্রেমে পড়েননি, এমন পুরুষ কিংবা নারী খুঁজে পাওয়া ভার। তাঁর চরম শত্রুরাও তাঁর ভালোবাসার শক্তির কাছে হার মেনেছেন। কবি বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে প্রথম দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। তিনি লিখেছেন, ‘সেই প্রথম আমি দেখলাম নজরুলকে। এবং অন্য অনেকের মতো যথারীতি তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম!’ শুধু বুদ্ধদেব বসু নন, তাঁর স্ত্রী প্রতিভা বসুও নজরুলের প্রেমে পড়েছিলেন। সেই কাহিনি নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘আয়না’ নামে একটি গল্প। কী অবাক কাণ্ড! স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একই লেখকের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন!


🌹৮. কাজী নজরুল ইসলাম প্রচুর পান ও চা খেতেন। লিখতে বসার আগে পর্যাপ্ত পরিমাণ চা আর এক থালা পান নিয়ে বসতেন তিনি। পান শেষ করে চা, এরপর আবার চা শেষ করে পান খেতেন। তিনি বলতেন, ‘লেখক যদি হতে চান/ লাখ পেয়ালা চা খান!’


🌹৯. নজরুল ছিলেন সত্যিকারের হস্তরেখা বিশারদ। তিনি অনেকের হাত দেখে যা বলতেন, তা-ই ঘটতে দেখা গেছে। একবার এক লোককে বললেন, আপনার বিদেশযাত্রা আছে, লোকটি সত্যিই কয়েক দিনের মধ‌্যে বিদেশ চলে গেল! আরেকজনকে বললেন, ‘আপনি পৃথিবীর বাইরে চলে যেতে পারেন।’ পরে ওই লোকটির মৃত্যু ঘটেছিল!


🌹১০. মাঝেমধ্যে রাগান্বিত হলে নজরুল তাঁর সামনে যদি কোনো বই-খাতা পেতেন বা কাগজ পেতেন, তা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফেলতেন।


🌹১১. অর্থের ব্যাপারে নজরুল ছিলেন ভয়াবহ বেহিসাবি। হাতে টাকা এলেই তা বন্ধুবান্ধব নিয়ে আমোদ-ফুর্তি করে শেষ করে দিতেন। আর বলতেন, ‘আমি আমার হাতের টাকা বন্ধুদের জন্য খরচ করছি। আর যখন ওদের টাকা হবে ওরাও আমার জন্য খরচ করবে, চিন্তার কোনো কারণ নেই।’


🌹১২. নজরুল তাঁর দুই পুত্রের ডাকনাম সানি (কাজী সব্যসাচী) আর নিনি (কাজী অনিরুদ্ধ) রেখেছিলেন তাঁর দুই প্রিয় মানুষ সান ইয়াত-সেন ও লেনিনের নামানুসারে।


🌹১৩. নজরুল তাঁর সন্তানদের খুবই ভালোবাসতেন। এমনকি তিনি তাঁদের নিজ হাতে খাওয়াতেন আর ছড়া কাটতেন, ‘সানি-নিনি দুই ভাই/ ব্যাঙ মারে ঠুই ঠাই।’ কিংবা ‘তোমার সানি যুদ্ধে যাবে মুখটি করে চাঁদপানা/ কোল-ন্যাওটা তোমার নিনি বোমার ভয়ে আধখানা।’


🌹১৪. নজরুল ছিলেন সত্যিকারের জনদরদি মানুষ। একটি ঘটনা দিয়ে তার প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে। দক্ষিণ কলকাতার এক দরিদ্র হিন্দু মেয়ের বিবাহ। কোনোরকমে কন্যা বিদায়ের আয়োজন চলছে। নজরুল খবরটি পেলেন। তিনি দ্রুত বাজারে গেলেন। এক হিন্দু বন্ধুকে নিয়ে বিয়ের বাজার করলেন। তারপর ধুমধাম করে মেয়েটির বিয়ে হলো। মেয়ের বাবা নজরুলকে প্রণাম করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমরা আপনাকে ভুলব না কোনো দিন।’ এমনই ছিলেন কবি। তাঁর বাড়িতে সাঁওতাল, গারো, কোল—সবাই দল বেঁধে আসতেন। আপ্যায়িত হতেন উৎসবসহকারে।


🌹১৫. নজরুল কবিতা ও গানের স্বত্ব বিক্রি করে উন্নত মানের একটি ক্রাইসলার গাড়ি কিনতে পেরেছিলেন। এই গাড়ি ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বিলাসবহুল ও দামি।


🌹১৬. নজরুল ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরা ভাড়া করে মাঝেমধ্যে প্রমোদভ্রমণে যেতেন।


🌹১৭. নজরুলের দৃষ্টিশক্তি ছিল অসামান্য। তিনি গভীর অন্ধকারেও বহুদূরের কোনো জিনিস স্পষ্ট দেখতে পেতেন।


🌹১৮. নজরুল ছিলেন অসম্ভব রকমের ক্রীড়াপ্রেমী। সময় পেলেই তিনি ফুটবল খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে ছুটতেন বন্ধুবান্ধব নিয়ে। যেদিন বাড়ি থেকে সোজা খেলা দেখতে যেতেন, সেদিন দুই পুত্র সানি আর নিনিকে সঙ্গে নিতেন। একবার খেলা দেখতে গেছেন। স্টেডিয়ামে পাশে বসে আছেন হুমায়ূন কবির। খেলা ভাঙার পর ভিড়ের মধ্যে দুই পুত্র খানিকটা আড়ালে চলে গেল। হঠাৎ পেছন থেকে নজরুলের হাঁকডাক শোনা গেল, ‘সানি কোথায়? নিনি কোথায়?’ মাঠসুদ্ধ লোক হাঁ হয়ে নজরুলকে দেখছে। এরই মধ্যে দুই পুত্রকে ঠেসে ধরে ট্যাক্সি করে বাড়ি নিয়ে এসে তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।


🌹১৯. নজরুল বেশ দক্ষ দাবাড়ু ছিলেন। যেদিন বিশেষ কোনো কাজ থাকত না, সেদিন তিনি দাবা খেলতেন। খেলায় এমন মগ্ন হতেন যে খাওয়া-নাওয়ার খেয়ালও থাকত না। মাঝেমধ্যে নজরুলের বাড়িতে দাবার আসর বসাতে আসতেন কাজী মোহাতার হোসেন ও হেম সোম।


🌹২০. কলকাতায় নজরুলের তিনতলা বাড়ির সামনে ছিল একটা ন্যাড়া মাঠ। খেলা নিয়ে বহু কাণ্ড ঘটেছে ওই মাঠে। একবার জোর ক্রিকেট খেলা চলছে। নজরুল গ্যালারি অর্থাৎ বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেলারত তাঁর দুই পুত্রকে জোর উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে বড় পুত্র সানি এল ব্যাট করতে। প্রথম বলেই ছয়! নজরুলের সে কি দাপাদাপি! ঠিক পরের বল আসার আগে তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘সানি, ওই রকম আরেকটা মার।’ ব্যস বাবার কথায় উত্তেজিত হয়ে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ব্যাট চালাল পুত্র। ব্যাট অবশ্য বলে লাগল না। লাগল উইকেটকিপারের চোয়ালে! বেশ রক্তারক্তি অবস্থা! অবশেষে খেলা বন্ধ করা হলো।


এমনই নানা রঙের মানুষ ছিলেন নজরুল। যাঁর জীবনে দুঃখ-কষ্টের অভাব ছিল না, আবার রং-রূপেরও অভাব ছিল না। পৃথিবীর খুব কম মানুষই বোধ হয় এমন  মহাজীবনের অধিকারী হন। বুদ্ধদেব বসু যথার্থই বলেছিলেন, ‘কণ্ঠে তাঁর হাসি, কণ্ঠে তাঁর গান, প্রাণে তাঁর অফুরান আনন্দ—সব মিলিয়ে মনোলুণ্ঠনকারী এক মানুষ।’


___ নজরুল অঞ্জলি 

(সংগৃহীত)

হাসন রাজাঃ বাংলাদেশের  বিখ্যাত এক মরমী কবি

 হাসন রাজাঃ

বাংলাদেশের  বিখ্যাত এক মরমী কবি

-----------------------------------------------------

লোকে বলে বলেরে

ঘর বাড়ি ভালো না আমার

কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার...

বিখ্যাত এই  মরমী গানের  কবি ও সাধক হাসন রাজা। হাসন রাজা  ১২৬১ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ ও ১৮৫৪ সালের ২১শে ডিসেম্বর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জে লক্ষ্মণশ্রী গ্রামের এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। উনার প্রকৃত নাম ছিল দেওয়ান হাসন রজা চৌধুরী। 


তাঁর পিতার নাম দেওয়ান আলী রজা চৌধুরী। হাসন রাজার পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয়ই ছিল অযোধ্যাবাসী এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী। হাসন রাজারা পরে  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাঁরা সুনামগঞ্জ আসেন এবং সেখানেই জমিদারি পত্তন করে স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন।


হাসন রাজার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। মাত্র পনেরো বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ হলে সংসার ও জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত হয়। যৌবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৌখিন ও ভোগবিলাসী, কিন্তু পরিণত বয়সে সব বিষয়-সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে দরবেশ জীবন যাপন করেন।


 তাঁরই উদ্যোগে সুনামগঞ্জ হাসন এম ই স্কুল, অনেক ধর্ম-প্রতিষ্ঠান ও  আখড়া স্থাপিত হয়। বিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী ছাত্রের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও তিনি করতেন।


প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও হাসন রাজা ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় এক হাজার আধ্যাত্মিক গান রচনা করে সুর দিয়ে নিজ আখড়ায় পরবেশন করতেন। 


স্থানীয় বাউল-ফকিরেরা পর্যায়ক্রমে  সেসব গান গেয়ে হাসন রাজাকে আরও বেশি  পরিচিত করে তোলে। হাসন রাজা ছিলেন একজন ঐশীপ্রেমী এবং সেই প্রেমে মাতোয়ারা হয়েই তিনি সকল  গান রচনা কতেন।


 তাঁর গানে প্রেম ও বৈরাগ্যময় আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর গানগুলি যেন হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের একটি মিলন ক্ষেত্র। তাই সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষজন তার গানের প্রতি গভীর আগ্রহী। 


তিনি গানের ভণিতায় নিজেকে ‘পাগলা হাসন রাজা’, ‘উদাসী’, ‘দেওয়ানা’,  ‘বাউলা’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। এক সময়ে তিনি কৈশোর ও যৌবনে শ্রীকৃষ্ণের নানাবিধ লীলায় অভিনয়ও করেছেন।


হাসন রাজার মুখ্য পরিচয় একজন মরমি কবি হিসেবে। তাঁর সম্পর্কে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন: ‘পূর্ববঙ্গের একজন গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধসূত্রেই বিশ্ব সত্য।


বর্তমানে হাসন রাজার যাবতীয় গানের সংগ্রহ গুলো  হাছন উদাস (১৯০৭), শৌখিন বাহার, হাছন বাহার ইত্যাদি গ্রন্থে তাঁর গানগুলি পর্যায়ক্রমে  সংকলিত হয়েছে।


 ১৯২২ সালের ৬ই ডিসেম্বর মরমী কবি গীতিকার ও সুরকার হাসন রাজা ইহকাল ত্যাগ করে পরপারে চলে যান। 


এই মহান মানুষটিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

(Alim Al Rashid)

শুভ জন্মদিন নীনা হামিদ জন্মঃ ২৬ ডিসেম্বর ১৯৪৯

 আমার সোনার ময়না পাখি কোন দেশেতে গেলা উইড়া রে দিয়া মোরে ফাঁকি রে আমার সোনার ময়না পাখী...অসাধারণ এই গানটি গেয়েছেন পল্লীগীতি সম্রাজ্ঞী শিল্পী নীনা হামিদ। নীনা হামিদের কণ্ঠে আমার খুব ছোটবেলায় শোনা এই গান। নীনা হামিদের সেই দরদী কণ্ঠ ভুলবার নয়। নীনা হামিদের অসাধারণ গায়কী যারা শুনেছেন তারা আজীবন মনে রাখবেন এই শিল্পীকে। গানটির কথা ও সুরঃ মোহাম্মদ ওসমান খান। এই গানটি খুব জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবি ’মনপুরা’ ছবিতে গেয়েছেন অর্ণব। ওয়াসিম ও অঞ্জু অভিনীত রাজকুমারী ছবিতে গেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন।

শুভ জন্মদিন

নীনা হামিদ

জন্মঃ ২৬ ডিসেম্বর ১৯৪৯

----------------------------------------------------

নীনা হামিদের জন্ম শিক্ষিত, সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল সম্‌ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তার বাবা আবু মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ খান ছিলেন পুলিশ অফিসার। মা সফুরুন নেছা। ভাই বোনদের মধ্যে নীনা হামিদ ছিলেন সবচেয়ে ছোট। তার পৈতৃক ভিটা ছিল মানিকগঞ্জ জেলার পারলি নওদা গ্রামে। কোনদিন যাওয়া-আসা ছিল না গ্রামের বাড়িতে। তবে তাদের পরিবার গোড়া থেকেই গান-বাজনা, কবিতা-আবৃত্তির চর্চা করতো। তার বাবার পক্ষে সাংস্কৃতিক চর্চা সম্ভব হয়নি, কেননা তিনি ছিলেন পুলিশ বিভাগে কর্মরত, কর্মজীবনে তিনি ব্যস্ত সময় কাটাতেন। তবে তাঁর ছেলেমেয়ে সংস্কৃতিমনস্ক হোক এটা তিনি সব সময় চাইতেন। ১৯৫৬ সালে নীনা হামিদ ধ্রুপদী সংগীতে বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে ভর্তি হন। সেইসঙ্গে তার ভাই মোজাম্মেল হোসেনও ভর্তি হন সেতারে। বোন রাহিজা খানম ঝুনু নৃত্যে এবং আরেক বোন রাশিদা চৌধুরী রুনু ভর্তি হন রবীন্দ্রসংগীত বিভাগে।

নীনা হামিদ দীর্ঘদিন যাবত দেশের বাইরে। স্বামী শিল্পী এম এ হামিদের সাথে বসবাস করছেন সুদূর আমেরিকার আটলান্টিক সিটিতে। একসময় তাঁর কণ্ঠমাধুর্যে মুগ্ধ হত শ্রোতা-দর্শক। যাঁর গান শুনে বাংলাদেশের লাখো শ্রোতা চোখের পানি ফেলতেন। জীবনে তিনি অনেক কিছুই পেয়েছেন -”গানের কোকিল” পদবি, বাংলাদেশের শ্রোতাদের ভালোবাসা। 

নীনা হামিদ খুব ছোটবেলা থেকেই গান করেন। নিখিল দেবের কাছে তার গানের হাতেখড়ি। প্রতিবছরই স্কুলে গানের প্রতিযোগিতায় তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাসন্তী গুহ তার নাম লেখাতেন। তিনি নীনা হামিদের নাম দেন ”কোকিল” তখন তিনি পল্লীগীতি ছাড়াও সব ধরনের গান গাইতেন। সুরকার আবদুল আহাদ নীনা হামিদের বড় বোন আফসারী খানমকে গান শেখাতেন। একদিন তিনি নীনা হামিদের কণ্ঠ শুনে বিস্মিত হলেন। এরপর তিনি নীনা হামিদকে উচ্চাঙ্গসংগীত শেখাতে শুরু করলেন। তারপর ওস্তাদ বিমল দাস, বারীণ মজুমদার তাঁদের কাছে গান শিখলেন। ওই বয়সে একবার সরকারি আমন্ত্রণে নীনা হামিদ পাকিস্তানের মুলতানে গেলেন। সেখানে সালামত আলী, নাজাকাত আলী, নুরজাহান, মেহেদি হাসান, সুরাইয়া সুলতানিকা, এনায়েত ভাট্টি এঁরাও গান করবেন। সেই অনুষ্ঠানে নীনা হামিদও গাইলেন। এরপর রেডিওতে খেলাঘরের অনুষ্ঠানে আবদুল আহাদ নিয়ে গেলেন। সেখানে মোটামুটি নিয়মিত ক্লাসিক্যাল গান গাইতে শুরু করেন। স্কুল ব্রডকাস্টিং প্রোগ্রামে নিলুফার ইয়াসমিন, ওমর ফারুক ও হোসনা ইয়াসমীন বানুর সঙ্গে গেয়েছেন। 

একদিন মানিকগঞ্জের ওসমান খান (গীতিকার ও সুরকার) তাদের বাড়িতে এলেন। তিনি নীনা হামিদের মেঝো বোন রাশীদা খানমকে দিয়ে এইচএমভি কোম্পানির জন্য একটা গান করাবেন। রাশীদা গাইতেন রবীন্দ্রসংগীত। প্রস্তাব শুনে রাশীদা ’না’’ করে বসলেন। তখন সুযোগটা নিলেন নীনা এবং ওই গানটা গাওয়ার আবদার করে বসলেন। ওসমান খান রাজি হলেন। এরপর সেই রেকর্ডিং। সেই গানের সঙ্গে শ্রেষ্ঠ যন্ত্রশিল্পীরা ছিলেন কানাই লাল শীল (দোতারার স্রষ্টা), বাঁশিতে ধীর আলী মিঞা, তবলায় বজলুল করিম, একতারায় যাদব আলীসহ (তিনি সুপণ্ডিত আলাউদ্দীন আলীর বাবা) আরও অনেকে বাজালেন। এরপর ’কোকিল আর ডাকিস না...’ রেকর্ডটি বের হলো। এর কিছুদিন পর এইচএমভির আখতার আব্বাস বললেন, এ রকম বাংলা গানের এলপি রেকর্ডসের এত কাটতি অনেক দিন দেখিনি। 

নীনা হামিদের রূপবান পালার কথা অনেকেই জানেন। রূপবান যাত্রাপালা রেকর্ড করা হতো, এটার স্রষ্টা ছিলেন খান আতাউর রহমান। ছোট ছোট গান ছিল এতে। ’ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো আমার দাইমা দাই মা গো...’,

’শোন তাজেল গো মন না জেনে প্রেমে মইজো না’... ’সাগর কূলের নাইয়া...’ এমন অপূর্ব শক্তিশালী গান ছিল সেগুলো। সেগুলো এত জনপ্রিয় হলো, সেখান থেকে তৈরি হলো রূপবান ছবি। রূপবান ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৫ সালে। এর অনেক ডিমান্ড ছিল। গ্রাম থেকে নৌকায়,গরুর গাড়িতে বোঝাই করে দলবেঁধে মানুষ যেতো শুধু রূপবান দেখতে। সেই রূপবান-এর গানের পরে একটা হিড়িক পড়ে গেল ফোক ছবি বানানো। পাতালপুরীর রাজকন্যা, জংলি মেয়ে, সুয়োরানী দুয়োরানী, গুনাই বিবি, গোলাপী এখন ট্রেনে, কুচবরণ কন্যা এমন অনেক রূপকথার গানের ছবি। এই গানগুলোর জন্যই নীনা হামিদ ও আবদুল আলিম সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। বিদেশে ওখানকার মানুষ বাংলা ভাষা না বুঝলেও সুরেই তারা চোখ ভাসাত। এখানেই নীনা হামিদের সার্থকতা। আমাদের গানের ইতিহাস, জসীমউদ্দীনের নকশিকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, পল্লীগানের ইতিহাস সংরক্ষণ করা উচিত।

নীনা হামিদের বিখ্যাত গান গুলোর মধ্যে রয়েছে - আমার সোনার ময়না পাখি, ওহ কি গাড়িয়াল ভাই, আগে জানিনারে দয়াল, আইলাম আর গেলাম, আমার বন্ধু বিনোদিয়া, আমার গলার হার, আমায় কি যাদু করলি রে, এমন সুখ বসন্ত কালে, যারে যা চিঠি লিইখা দিলাম, যোগী ভিক্ষা লয় না, ওরে ও কুটুম পাখি, উজান গাঙের নাইয়া- এ রকম আরো অনেক গান।

আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ পল্লীগীতি শুনতে খুব পছন্দ করেন। এখন কেমন তা জানিনা, তবে আগেকার দিনে অর্থাৎ ষাটের দশকে গ্রামগঞ্জে বিয়ে-শাদি,খতনা ইত্যাদিতে কলের গান ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। কোনো অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত, জমজমাট করার জন্য কলের গান ছাড়া যেন ভাবাই যেত না। নীনা হামিদ, আব্বাসউদ্দিন, আবদুল আলীম, মুস্তফা জামান আব্বাসী, ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে কলের গানের ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতির কথায় আজও গ্রামের প্রবীণরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

১৯৫০ সালে প্রকাশিত জসীমউদ্দীনের ’পদ্মাপার’ গ্রন্থে ৪২টি গান ও একটি গীতিনাট্য স্থান পেয়েছে। এ বইয়ের গানগুলোয়ও পল্লীর সাধারণ মানুষের জীবনযাপন তাদের হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, ঘরকন্না, আধ্যাত্মিক চেতনা ইত্যাদি নিপুণভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বেদে-জীবনের নিখুঁত চিত্র পাই এই গানটিতে - ও বাবু সেলাম বারেবার, আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু, বাড়ি পদ্মাপার। মোরা পঙ্খি মারি পঙ্খি ধরি মোরা পঙ্খি বেইচা খাই, মোদের সুখের সীমা নাই, পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের লেখা এই গানটি সুর করেছেন আলতাফ মাহমুদ। বেদের মেয়ে ছবিতে এই গানটি গেয়েছেন আবদুল আলীম ও নীনা হামিদ। গানটি রেকর্ড করা হয় ১৯৬৮ সালে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালে। নীনা হামিদ বেশ কিছু ছায়াছবির গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন।

নীনা হামিদের আরেকটি বিখ্যাত গান - ওহ কি গারিয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে...অসাধারণ গেয়েছেন। নীনা হামিদের মত এমন শিল্পী আর হবে না। তখনকার দিনের আব্বাসউদ্দিন, আবদুল আলীম, নীনা হামিদ, ফেরদৌসী রহমান, আঞ্জুমান আরা, বশির আহমেদ, নিলুফার ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমত উল্লাহ, মাহমুদুন্নবী, আব্দুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রুনা লায়লা এবং সাবিনা ইয়াসমিন সহ আরো অনেকেই আমাদের সংগীতের পিপাসা মিটিয়েছেন নিঃশব্দে, যার জন্য আমরা আরো বেশী সংগীত পিপাসু হয়েছি। আমার মতে সেই সময়টা বাংলা গানের স্বর্ণযুগ ছিল। সে সময়ে গানের যেমন ছিল সুর তেমনি ছিল গানের কথা।

নীনা হামিদ দেশ ছেড়ে যাবার অনেক পরে তাকে দেয়া হয়েছে একুশে পদক। ১৯৯৪ সালে একুশে পদক পেলেন পল্লীগীতি সম্রাজ্ঞী শিল্পী নীনা হামিদ। তার পক্ষে তার ছোট ভাই সেই পদক গ্রহণ করেছিলেন।

শিল্পী  নীনা হামিদ দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে বাস করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে। 

রওশন আরা বিউটি

সঙ্গীত গবেষক ও প্রাবন্ধিক


✍️মানিক বিশ্বাস ✍️

মির্জ গালিব ৷

 মির্জ গালিব ৷

মোগল সাম্রাজ্য অস্ত যাওয়ার কালে ছিল উর্দু কাব্যের সবচেয়ে অহঙ্কারের যুগ। এর কারণ বোধ হয় এই যে, উর্দু কাব্য বাইরের প্রকৃতির চাইতে মানুষের মনোজগতের প্রকৃতির দিকেই বেশি মনোযোগী। আর দীর্ঘ দিনের শাসনের, সংস্কৃতির অধিকার থেকে সরে যাওয়ার এমন দুর্যোগ ভারতবর্ষের বুকে কমই নেমেছে।  মির্জা গালিব সেই বেদনার শ্রেষ্ঠ রূপকার। একজন মান্য কাব্য আলোচকের মতে—ভারতবর্ষে দু’টো মাত্র প্রেরিত পুস্তক আছে, একটি পবিত্র বেদ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে গালিবের কাব্য সংকলন। ১৭৯৭ সালে আগ্রায় জন্ম নিয়ে ছিলেন মির্জা আসাদুল্লাহ খান। কবি নাম ‘গালিব’, যার অর্থ বিজয়ী।  কৈশোরের পর জীবনের বাকি অংশ কাটিয়েছেন দিল্লিতে। ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক মানুষদের মধ্যে অন্যতম তিনি।  বলা হয়—কাব্য যদি ধর্ম হয়, তবে গালিবকে না বোঝা মানে কাফের হওয়া! গালিব দৃশ্যকল্পের কবি। মাত্র ২৩৪টি গীতিকবিতা আছে তাঁর চলতি কাব্য সঙ্কলনে।  তাতেই তিনি উর্দু কাব্যের অধীশ্বর।]

শ্রদ্ধার্ঘ্য | ঋত্বিক ঘটকের জীবন সম্পর্কে জানতে অবশ্যই পড়ুন তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটকের লেখা বই ঋত্বিক । এই বই সংগ্রহে রাখার মত বই ।

 "সাদা রংয়ের একটা এ্যাম্বাসেডরের পিছের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন সুচিত্রা। তীব্র দাবদাহ, পুরো কলকাতা পুড়ছে। এ্যাম্বাসেডর পার্ক স্ট্রিটে ঢুকে একটু আগাতেই ফুটপাতে একজনকে দেখে সোজা হয়ে সিটে বসলেন সুচিত্রা। 


ড্রাইভারকে গাড়ি সাইড করতে বলে নিজেই নেমে এগিয়ে গেলেন সেই মানুষটার দিকে। এই কাঠফাটা গরমে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছেন স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক। 


হাত জোর করে প্রণাম করতে করতে সুচিত্রা বললেন

– আমাকে চিনতে পারছেন ঋত্বিক দা? আমি সুচিত্রা, গত বছর শান্তিনিকেতনে দেখা হলো।

চশমার উপর দিকে তাকিয়ে ভালো করে মুখটা দেখলেন ঋত্বিক, তারপরে বললেনঃ

– ও হ্যা। তুমি সুচিত্রা রায় তো? টালিগঞ্জ বাড়ি। অন্নদাশঙ্কর রায় তোমার কী রকম জ্যাঠা হন না? ঠিক বলেছি তো?


সুচিত্রা আপ্লুত হলেন। কি সৌভাগ্য! এত বড় মানুষটা সব মনে রেখেছে। সুচিত্রা কলকাতার শিল্পপ্রেমী বনেদি পরিবারের মেয়ে, জন্মের পর থেকেই কলকাতার সব মহিরুহদের সামনে দেখে বড় হয়েছেন; ইদানিং প্রায়ই বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ে প্রবন্ধনিবন্ধ লেখেন। ঋত্বিক ঘটক এর মূল্য সে বোঝে। ঋত্বিক ঘটক কে মনে মনে গুরু মানে সুচিত্রা। 

ঋত্বিকদার পরনে ধুলিমলিন পাজামা-পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। এক মাথা এলোমেলো চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা। সে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।এই জবুথবু অবস্থাতেও ঋত্বিকের চোখের আগুন একফোটা কমে নি, ঋত্বিক ঘটক মানেই এক আগুনের নাম। মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা-এসব ছবিগুলোয় যে আগুনের ছাপ স্পষ্ট।


সুচিত্রা খেয়াল করলেন ঋত্বিকের পিছনে একটা ব্যানারে বড় করে লেখা “বাংলা দেশের শরণার্থীদের জন্য দান করুন।”। ব্যানারের পাশেই একটা বড় বাক্স, সেখানে রাস্তার মানুষ টাকা ফেলে যাচ্ছে। 


বাক্সের পাশেই লম্বা একটি টুল। তার ওপর গিটার হাতে এক বিদেশি তরুণ বসে আছে। গায়ের রং তামাটে, হিপিদের মতো লম্বাচুল, চোখে সানগ্লাস আর মুখ ভর্তি লালচে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনে ঢোলা বেলবটম প্যান্ট আর রঙ্গিন হাওয়াই শার্ট। মাথায় একটি সাদা রঙের সোলার হ্যাট। 

গিটার আর মাউথ অর্গান বাজিয়ে নাকি গলায় তরুণটি গাইছে:

Come senators, congressmen

Please heed the call

Don’t stand in the doorway

Don’t block up the hall


গানটা সুচিত্রার পরিচিত, কিংবদন্তি গায়ক বব ডিলানের গান। ঋত্বিক তরুণকে দেখিয়ে বললেন, ও হল স্টিভ টার্নার। গায়ক ও সাংবাদিক। সপ্তাহ খানেক হল আমেরিকা থেকে এসেছে। স্টিভ-এর সঙ্গে কবি অ্যালান গিনসবার্গও কলকাতা এসেছেন।


স্টিভকে হ্যালো বলে কৌতুহলী সুচিত্রা জানতে চাইলেন গিনসবার্গ কোথায়। ঋত্বিক বললেন,অ্যালান আজ সকালে শক্তির সঙ্গে বারাসাত শরনার্থী শিবিরে গিয়েছে।


– শক্তি? মানে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়?

– হ্যা। গতকাল অবধি টাকাপয়সা যা জমেছিল তা দিয়ে ওরা ওষুধ আর খাবার কিনে নিয়ে গেল ।

ঋত্বিক সুচিত্রাকে বললেন ‘এলেই যখন, দুটো টাকা দিয়ে যাও’, বলে ঋত্বিক হাত বাড়ালেন। লজ্জায় মাথা নিচু করে সুচিত্রা বললেন ‘ছিঃ দাদা। এমন করে বলছেন কেন? আমি কি দূরের কেউ?’। বলেই কড়কড়া কয়েকটা ১০০টাকার নোট দিলেন ঋত্বিকের হাতে। হঠাৎ করে ঋত্বিক সুচিত্রাকে প্রশ্ন করলেনঃ

– সুচিত্রা তুমি একসঙ্গে কত লাশ দেখেছ? ১০০? ২০০? ৩০০? ৪০০? ৫০০? ৬০০? ৭০০? ৮০০? ৯০০?

এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই অদ্ভুত এক ঘোরলাগা নিয়ে সুচিত্রা আবার এ্যাম্বাসেডরে চড়ে বসলেন। 


যে ভূখন্ডের অসহায় মানুষের জন্য এই পাগলাটে মানুষটা  তীব্র তাপদাহে পুড়েছেন, কেঁদেছেন,চিৎকার করেছেন সেই ভূখন্ডে তো ঋত্বিকদা আর কখনোই ফিরে যাবেন না জেনেও। ঋত্বিকদারা পরিবারসহ ’৪৭ সালেই এ পাড়ে চলে এসেছেন । 


তবুও … এত বড় ফিল্ম ডিরেক্টর, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, যে ঋত্বিক ঘটককে জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে তুলনা করা হয় সে মানুষটি কেমন নাওয়াখাওয়া ভুলে জ্বলন্ত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য ভিক্ষে করছেন।


তাঁর সৃষ্টি এখনও বাঙালিকে ভাবা প্র্যাকটিস করে। ক্রমাগত বলেই চলেছেন, “ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।”


শ্রদ্ধার্ঘ্য |


ঋত্বিক ঘটকের জীবন সম্পর্কে জানতে অবশ্যই পড়ুন তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটকের লেখা বই ঋত্বিক । এই বই সংগ্রহে রাখার মত বই ।

সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রাআত্মহনন করেন, একটি বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই মুহূর্তে সাপ ছোবল মারে তাঁর বুকে।

 সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রাআত্মহনন করেন, একটি বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই মুহূর্তে সাপ ছোবল মারে তাঁর বুকে। ক্লিওপেট্রা ....মিশ...