॥ এত সুর আর এত গান ॥
সা রে গা মা পা ধা নি — এর বাইরে কখনো সুর হয় না। আর যখন কিছু কথা এই সাত স্বরের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, ছুঁয়ে যায় আমাদের মনকে, আমরা বলি ‘গান’।
গানকে ঘিরে থাকে নানান ঘটনার ঘনঘটা। কখনো গায়ক, কখনো গীতিকার, আবার কখনো বা সুরকারের অকপট স্বীকারোক্তিতে এইসব ঘটনা সামনে আসে আমাদের। আর সেইসব গল্প নিয়েই “কিছু কথা ॥ কিছু সুর।”
আজকের গল্প সেই শিল্পীকে নিয়ে, যার গলাকে বলা হয় স্বর্ণযুগের স্বর্ণকন্ঠ। যার দাপট শুধু বাংলা আধুনিক গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, হিন্দি ছায়াছবির গানেও ছিল অসামান্য। তিনি সুবীর সেন। আজকের দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন অজানার উদ্দেশ্যে। শিল্পীর প্রয়াণ দিবসে তাঁকে নিয়েই আজ আমাদের এই বিশেষ পর্ব।
একদিন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভূপেন হাজারিকা গ্র্যান্ড হোটেলের প্রিন্সেস এ গিয়েছেন। সেখানে প্রায়ই বিদেশি ক্যাবারে আসত, ফলে নিত্যনতুন সুর পাওয়া যেত।
দুজন গিয়ে দেখলেন বিশাল বিশাল ট্রিপল কঙ্গো বাজাচ্ছেন বিদেশি কৃষ্ণাঙ্গ বাদ্যযন্ত্রীরা। ভূপেনবাবু পুলকবাবুকে বললেন — “ছন্দটা ধরে ফেলুন”। পুলকবাবু সেই ছন্দের ভাঁজে ভাঁজে কথা বসিয়ে ওখানেই লিখে ফেললেন গানটি। অনবদ্য সুর করলেন ভূপেন হাজারিকা।
গান তো তৈরি হল। এইবার প্রশ্ন, গাইবে কে?
দুজন একসাথে বললেন — “সুবীর সেন!”
তৈরি হল–
“কালো মেঘে ডম্বরু
গুরু গুরু ওই শুরু!
তবু তো ভাসাই তরী...
বিভীষিকা ঘন আধারে..
ডেকেছ তুমি যে আমারে।”
সুবীর সেনের বাড়ি এবং বেড়ে ওঠা আসামের ডিব্রুগড়ে। বাড়িতে তখন গানের একটা পরিবেশ ছিল। সেই সময় ভারতবর্ষে বসুমতী পত্রিকায় গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হত। আর এই পত্রিকা গুলো বাড়িতেও আসত। বাবা সেই স্বরলিপি দেখে গান তোলার চেষ্টা করতেন। আর মা গুনগুন করে গান গাইতেন ঘরোয়াভাবে খালি গলায়। কিন্তু এতকিছুর পরেও বাড়ির সবাই চেয়েছিলেন সুবীর সেন যেন ডাক্তার হন। কারণ বাবা ছিলেন পেশায় ডাক্তার, আর তাঁদের পারিবারিক ওষুধের ব্যবসাও ছিল। কিন্তু গান যার নেশা, তার পক্ষে কি আর ডাক্তারি পড়া সম্ভব?
ডিব্রুগড়ে একটা গানের স্কুল ছিল। পারিবারিক নানা বাধানিষেধ কাটিয়ে সুবীর সেখানে ভর্তি হলেন। সেখানেই মাঝেমধ্যে আসতেন রাগাশ্রয়ী গায়ক- পন্ডিত রতন ঝংকার। তাঁর কাছে গানের হাতেখড়ি সুবীরের। গানের পরীক্ষায় সেখানে প্রথম হলেন সুবীর সেন। তারপর ওখানেই ম্যাট্রিক পাশ করে চলে এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন আশুতোষ কলেজে। থাকতেন মামাবাড়িতে। তখন তাঁর স্বপ্নের গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তালাদ মাহমুদ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখরা। ভাবলেন এঁদের মতো গান গাইতে গেলে তো গানটা ভালো করে শিখতে হবে আগে।
প্রথমেই গেলেন চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। সেখানে কিছুদিন শেখার পর চিন্ময়বাবু সুবীর সেনকে পাঠালেন ঊষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের কাছে ঠুমরি শিখতে।
সুবীর সেন তখন নিয়ম করে প্রতি রবিবার বিখ্যাত বিখ্যাত শিল্পীদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন। এরকমই একদিন গিয়ে হাজির অনুপম ঘটকের বাড়িতে। বাড়িতে তখন অন্য অনেকের ভীড়। জায়গা না পেয়ে বসলেন ছোট্ট ডিভানের একটা কোনে। ভীড় ফাঁকা হতে অনুপম ঘটককে বললেন যে তিনি গান শিখতে চান।
অনুপম ঘটক কিছুক্ষণ সুবীরের দিকে তাকিয়ে বললেন — “তোমার গান না শুনেই বলছি, তোমার গান হবে। দেখে নিও”।
পরে একদিন বলেছিলেন যে “যে জায়গায় সুবীর সেন অজান্তেই বসেছিলেন, সেটি ছিল গানের জায়গা। কারন সেখানেই একদিন এসে বসেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কে.এল. সায়গলের মতো দিকপালেরা।”
দূর্ভাগ্যবশতঃ অনুপম ঘটক বেশিদিন পৃথিবীতে ছিলেন না। ফলে তাঁর কাছে গান শেখাও হল না। কিন্তু তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। সুবীর সেন সত্যিকারের বড় গায়ক হয়েছিলেন।
এখন যেমন “সুপার সিঙ্গার”, “সারেগামাপা” “ইন্ডিয়ান আইডল” এর রমরমা, এতটা না হলেও পঞ্চাশের দশকেও কিন্তু ট্যালেন্ট হান্ট হত। তার মধ্যে অন্যতম সেরা ছিল HMV আয়োজিত “কেরেজু কম্পিটিশন ফর নিউ ট্যালেন্টস্”। এখানে নাম দিলেন কলেজ পড়ুয়া সুবীর সেন। প্রায় ১৪০০ প্রতিযোগীদের মধ্যে প্রথম হলেন তিনি। আর তারপর HMV-র সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি। নতুন গান বাছাই করার দায়িত্ব গায়কের। সুবীর পড়লেন মহা চিন্তায়। এর আগে বন্ধুদের সঙ্গে রেকর্ড কোম্পানিতে এসেছেন ঠিকই, রেকর্ডও করেছেন চিত্ত রায়ের সুরে, তবে সেই গানগুলো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তাহলে কি করা যায়? এইরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাজির হলেন উত্তর কলকাতার সিঁথি অঞ্চলে। ঠিকানা– 19/D গুপ্ত লেন। বাড়িটি একজন সঙ্গীত পরিচালকের।
তাঁকে গিয়ে সুবীর বাবু বললেন — “আমায় একটা ভালো গান দিন। আমি রেকর্ড করতে চাই।”
সুরকার ভদ্রলোক সব শুনে বললেন — “ভালো গান?” কিছুক্ষণ ভেবে তারপর একটা গান শোনালেন। তবে গানটা ঠিক পছন্দ হল না সুবীর সেনের। কিন্তু মুখের উপর “না” বলাও যায় না।
তাই সুবীরবাবু একটু চালাকি করে বললেন — “আচ্ছা আর একটা গান যদি শোনান....”
তখন ওই সুরকার ভদ্রলোক আরো একটা গান গাইলেন। আর সেটা শুনেই পছন্দ হয়ে গেল সুবীর সেনের।
বললেন — আমি এটাই গাইব!
কিন্তু সুরকার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আমতা আমতা করে বললেন — “মানে, আসলে, এটা তো আর একজনকে দেওয়ার কথা আছে..”
সুবীর সেন বললেন — “বেশ! ঠিক আছে। তাহলে আমি গাইব না। আমার কোনো গানই দরকার নেই।”
সুবীর সেনের এই নীরব অভিমান ছুঁয়ে গেল ওই সঙ্গীত পরিচালকের হৃদয়।
খানিক চুপ থেকে বললেন — “আচ্ছা গানটা গাও তো দেখি একবার।”
সুবীর বাবু গাইলেন।
শুনে সুরকার বললেন— “ঠিক আছে। গানটা তুমিই গাইবে।”
সেদিনের ওই সুরকার ছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। গানটি লিখেওছিলেন তিনি। আর এই একটা গানেই বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে নতুন গায়ক হিসেবে পরিচিত হলেন সুবীর সেন।
গানটি ছিল —
“ওই উজ্জ্বল দিন,
ডাকে স্বপ্ন রঙিন।
ছুটে আয় রে
লগন বয়ে যায় রে,
মিলনবীণ ওই তো তুলেছে তান
শোনো ওই আহ্বান”
১৯৫৮। গায়ক চললেন বম্বেতে। তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত ও আধুনিক গান শুনে স্বয়ং গুরু দত্ত তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সেখানে গিয়ে সুবীরের পরিচয় হল সঙ্গীত পরিচালক শঙ্কর জয়কিষান এর সঙ্গে। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। বলরাজ সাহানি, রাজেন্দ্র কুমার, শাম্মি কাপুর, মেহমুদ এর লিপে একের পর এক হিট গান উপহার দিয়ে চললেন সুবীর সেন।
আর বাংলাতেও তখন শিল্পীর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। যেমন সুদর্শন, তেমনই গানের গলা। ধীরে ধীরে ডাক আসতে লাগল অভিনয়ের জন্য। সুবীর সেনের বেশ ভালো পরিচয় ছিল ঋষিকেশ মুখার্জীর সঙ্গে। ঋষিবাবুও তাঁকে অভিনয়ের অফার দিলেন। কিন্তু সুবীরবাবু সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করলেন।
পরবর্তীকালে ওই ঋষিকেশ মুখার্জীরই অন্যতম সেরা ছবি “অভিমান” এ অমিতাভ বচ্চনের অভিনীত চরিত্রটির নাম ছিল “সুবীর কুমার”।
এইরকম নানান রঙিন ঘটনার সমাহার রয়েছে সুবীর সেনের সঙ্গীত জীবন জুড়ে।
এই বম্বেতে থাকাকালীনই তাঁর জীবনের আরও একটি সেরা গান তৈরি হয়েছিল। চলুন শোনা যাক সেই গল্প...
তখন বম্বেতে বাঙালিদের চাঁদের হাট। সুরকার, গায়ক অনেকেই। অনেকে আবার নিয়মিত বম্বে-কলকাতা করেন। বম্বেতে একই জায়গায় থাকতেন সুধীন দাশগুপ্ত ও সুবীর সেন।
একদিন সকালবেলা সুধীনবাবু বেশ গলা চড়িয়ে ডাক দিলেন— “অ্যাই সুবীর! এদিকে এসো। একটা গান লিখেছি, শোনো।”
এই বলে পড়ে শোনালেন সেই গান। গানের লিরিক্স শুনেই উচ্ছসিত সুবীর।
বললেন— দূর্দান্ত হয়েছে!
সুধীনবাবু বললেন— “গানটা তুমিই গাইবে।”
“কিন্তু সুর?”— ভ্রু কুঞ্চিত সুবীরের প্রশ্ন।
“ভাবছি..” — গালে হাত দিয়ে সুধীনবাবুর উত্তর।
পরদিন সকালেই আবার জরুরি তলব সুবীরবাবুকে। সুর হয়ে গেছে। আর তাও তিনি নিজেই করেছেন। গেয়ে শোনালেন সুবীরবাবুকে। গানটায় একটা ইংরেজি গানের ছায়া আছে। কিন্তু বাংলা কথার মোড়কে সুরকার যেভাবে সেটাকে মুড়ে নতুন রূপে উপস্থাপন করলেন, তা এককথায় অনবদ্য। রেকর্ডিং হল কলকাতায়। সুবীর সেনের গাওয়া সেরা গানগুলোর অন্যতম—
“এত সুর আর এত গান
যদি কোনদিন থেমে যায়,
সেইদিন তুমিও তো ওগো
জানি ভুলে যাবে যে আমায়...”
১৯৫৭ সালের এই গানের রেকর্ডের উল্টোপিঠে ছিল আরও একটা গান। আর সেটা নিয়েও রয়েছে গল্প–
গান লিখেছেন অনল চট্টোপাধ্যায়, আর নিজেই সুর করেও নিয়ে এসেছেন। শোনালেন সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত কে।
সুধীনবাবু শুনেই বললেন — “দারুন হয়েছে লেখাটা। কিন্তু সুর আমি করব!”
অনলবাবু বললেন — “সুর তো আমি করেই এনেছি অলরেডি।
সুধীনবাবু বললেন — “শুনুন না অনলবাবু, কথাগুলো যখন আপনি শোনাচ্ছিলেন, তখনই আমার মাথায় একটা দারুন সুর এসে গেছে। আমি সেটাই করতে চাই।”
অবশেষে ঠিক হল যে, সুধীনবাবুও ওই একই গানে সুর করবেন। তারপর যার সুরটা বেশি ভালো লাগবে, সেটাই ফাইনাল করা হবে। সুর করে নিয়ে এলেন সুধীনবাবু। সবাই শুনে বললেন সুধীনবাবুর সুরটাই থাক!
আর এভাবেই আরও একটা অন্যধরনের গান তৈরি হল —
“তোমার হাসি লুকিয়ে হাসে
চাঁদের মুখেতে..
আমার হাসি শ্রাবণ মেঘের
ধারার বুকেতে।”
বম্বেতে থাকাকালীন বিখ্যাত গায়ক-গায়িকা এবং সুরকারদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল সুবীর সেনের। এভাবেই একদিন তিনি গেছেন লতা মঙ্গেশকরের বাড়িতে। গিয়ে দেখলেন সেখানে রয়েছে লতাজীর বাবার ছবি, উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান এর ছবি, এবং এক বিদেশী কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ছবি।
সুবীরবাবু লতাজীকে জিজ্ঞেস করলেন — “ইনি কে?”
লতাজী বললেন — “ওই বিদেশী মানুষটির নাম- ন্যাট কিং কোল। অন্য অনেকের গান হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়, আর কিং কোল এর গান লোমকূপ দিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করে।”
এই বলে লতাজী কিং কোল এর একটি রেকর্ড সুবীর সেনকে দিলেন। গান শুনে অভিভূত সুবীরবাবু। তখন তিনি বেশ কিছু অনুষ্ঠানে হিন্দি ও বাংলা গানের পাশাপাশি ইংরেজি গানও গাইতেন। সুতরাং এ গানও অনায়াসেই গলায় তুলে নিলেন।
পরবর্তীকালে একটি গান রেকর্ড হয়েছিল, যার সুরকার ছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
সেই গানের মধ্যেও ন্যাট কিং কোল এর গানের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়—
“নয় থাকলে আরো কিছুক্ষন,
নয় রাখলে হাতে দুটি হাত..
নয় ডাকলে আরো কিছু কাছে,
দ্যাখো জোছনা ভেজা এই রাত.....”
অসম্ভব সুন্দর দেখতে ছিলেন সুবীর সেন। ফলে ছবিতে হিরো হবার অফার সবসময়ই আসত তার কাছে।
একদিন উত্তমকুমার তাকে ডেকে বললেন — “অভিনয় করো না কেন?”
সুবীর সেন কি আর বলেন! একথা সেকথা বলে কাটিয়ে দিলেন।
সে যাত্রায় তো রক্ষে হল, কিন্তু এরপর হঠাৎ একদিন পরিচালক সলিল দত্ত এসে হাজির তার বাড়িতে।
বললেন — “উত্তমকুমার আমাকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন ওই ছবিতে তোমাকে অভিনয় করতে হবে। তোমার বিপরীতে নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। এবং ছবিতে ডাক্তারের ভূমিকায় স্বয়ং উত্তমকুমার।”
উত্তমকুমারের আদেশ কিকরে অগ্রাহ্য করবেন! অগত্যা রাজি হলেন। ছবির নাম – “মোমের আলো”। সেখানে প্লেব্যাক তো করলেনই, ছবিতে লিপও মেলালেন।
ছবির একটি দৃশ্যে লং ড্রাইভে গাড়িতে বসে নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে উদ্দেশ্য করে এই গানটি অবশ্যই এই ছবির একটা অমূল্য সম্পদ—
“ওগো কাজল নয়না...
বলো বলো,
ওগো বলো,
তুমি কি গো সেই মধুমালা
মোর শত জনমের কামনা।
ওগো কাজল নয়না...”
শুধু বাংলা ছবিই নয়, হিন্দি ছবিতেও ছোটখাটো ভুমিকায় অভিনয় করেছেন সুবীর সেন।
পরিচালক বাসু ভট্টাচার্যের হিন্দি ছবি –“অনুভব”। নায়ক সঞ্জীব কুমার, নায়িকা তনুজা। এ ছবিতেও এক উল্লেখযোগ্য মুহূর্তে তাকে দেখা গেছে গান গাইতে।
পুরো হিন্দি ছবিতে একটিই মাত্র বাংলা গান। রবীন্দ্রসঙ্গীত—
“সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে,
ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা...”
রবীন্দ্রসঙ্গীতেও তাঁর দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা ছিল অতুলনীয়। একবার রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের হবার পর তার একটি কপি নিয়ে হাজির হলেন দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে। প্রিয় “জর্জদা” কে সেটি দিলেন শুনবার জন্য। এর দিনকয়েক পর আবারও সেখানে গেছেন। গিয়ে দেখলেন দেবব্রত বিশ্বাস গানের প্রথম লাইন শুনেই রেকর্ডের পিন টা তুলে নিচ্ছেন, আবারও চালাচ্ছেন, আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এভাবে বেশ কয়েকবার শুনলেন।
তারপরে সুবীরবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন— “কি অসাধারণ গাইসো তুমি!”
সত্যিই সেই গানটা অসাধারণ গেয়েছিলেন সুবীর সেন।
ফাংশনে তার জনপ্রিয় গানগুলোর মাঝে এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটিও বারবার গাইতে হত তাকে—
“তুমি যে আমারে চাও...
আমি সে জানি...
কেন যে মোরে কাঁদাও
আমি সে জানি...”
গানের জগতে সুবীর সেন যখন এসেছিলেন, তখন বাংলা গানে রথী-মহারথীদের ভীড়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন রীতিমতো। সকলের মাঝে থেকেও কন্ঠমাধুর্য এবং প্রতিভার জোরে শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন সুবীর সেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে টানা সত্তরের দশক পর্যন্ত খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন তিনি।
আজকের এই ছোট্ট প্রতিবেদনে কতটুকু আর তাঁকে ধরা সম্ভব? তবুও আজ তাঁর প্রয়াণের দিনে তাঁকে কিছুটা স্মরণ করার প্রয়াস করলাম মাত্র।
এখন এক পলকে দেখে নিই তাঁর গাওয়া কিছু গান–
চাঁদ তুমি এত আলো কোথা হতে পেলে
কথা- বঙ্কিম ঘোষ, সুর- অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
মোনালিসা, তুমি কে বলো না
কথা ও সুর - অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সারাদিন তোমায় ভেবে
কথা ও সুর - অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সন্ধ্যালগনে স্বপ্ন মগনে
কথা- শ্যামল ঘোষ। সুর- অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
নগর জীবন ছবির মতন
কথা - অমিয় দাশগুপ্ত। সুর - অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
স্বর্ণঝরা সূর্যরঙে
কথা ও সুর - সুধীন দাশগুপ্ত।
ডাকলেই সাড়া দিতে নেই
কথা- পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুর- অনিল চট্টোপাধ্যায়।
চন্দন আঁকা ছোট্ট কপাল
কথা- পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুর- অনিল চট্টোপাধ্যায়।
তুমি আমার প্রেম
কথা- মিল্টু ঘোষ। সুর- অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আকাশ যেখানে গল্প বলে পথকে
কথা- সুনীলবরন। সুর- সুধীন দাশগুপ্ত।
তুমি বলেছিলে কোনো মনের মুক্তো
কথা- অমিয় দাশগুপ্ত। সুর- অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
_____________________________
তথ্য সহায়তা: সারেগামা (HMV), আনন্দবাজার পত্রিকা ও অন্যান্য পত্র পত্রিকা।