সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে সবেমাত্র নিজের ঘরে এসে ফ্যানটা চালিয়ে বসেছি। এমন সময় রুপু এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ল। রুপু হল রূপকথা, আমার ছয় বছরের ভাইঝি। বাড়ির সকলের চোখের মণি। আমি ভ্রু তুলে জিজ্ঞাসা করলাম - " কি খবর রুপু সোনা? আজ সারাদিন কতটা দুষ্টুমি করেছ শুনি একটু?"
সে যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল। আধো আধো করে বলল - " শোনো পিপি, পাপাকে বলে দিও,পাপার সঙ্গে আমার কোনো কথাই নেই। পাপার সঙ্গে আড়ি আড়ি আড়ি, কাল যাব বাড়ি করে দিয়েছি"।
আমি ছদ্ম আশ্চর্য হওয়ার অভিনয় করে বললাম " আচ্ছা ! এ তো ভীষণ বড় ধরনের সমস্যা মনে হচ্ছে ! তা কি হয়েছে সেটা তো বলো। আড়ি কেন বাবার সঙ্গে?"
এমন সময় আমার মা ঢুকল, হাতে একটা কাঁচের গ্লাসে দুধ নিয়ে। রুপু দেখেই ঘরময় ছুটোছুটি শুরু করে দিল।দুধ তার ভারী অপছন্দ। মা বলল, " দেখেছিস তো, সারাটাদিন আমার ওপর দিয়ে কি যে যায় ! সত্তর পেরিয়ে গেছে আমার, সারা শরীরে ব্যথা শূলো,রোগবালাই, নানানরকম টেনশন নিয়ে আর পারি বল্ এই মেয়ে নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করতে? আমার কি আর সে বয়স আছে? নিজের মা তো গা ঝেড়ে ফেলে দিব্যি দায়সারা হয়ে গেল, আর আমার হয়েছে যত্ত জ্বালা...সেই বিকেল থেকে এই দুধের গ্লাস নিয়ে ঝামেলা চলছে। বাবু স্কুল থেকে এসে একটু জোর গলায় বকতেই মেয়ের রাগ হয়ে গেছে! এইটুকু মেয়ের বেলায় নেই, রাগের ঠেলায় জগত অন্ধকার !"
মায়ের কথা শেষ না হতেই রুপু ঘাড় ঘুড়িয়ে এদিকে ফিরল। পায়ে পায়ে খাটের পিছন থেকে আমার কোলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল - " থাম্মাম?ও থাম্মাম, দুধটা দাও। আমি আর দুষ্টু করব না।" বলে মায়ের থেকে গ্লাসটা নিয়ে একহাতে নাক টিপে কোনোরকমে দুধটা গলাধঃকরণ করল। আমি বুঝতে পারলাম কি তীব্র সেনসিটিভ হয়ে গেছে একরত্তি মেয়েটা! কিছু বোঝেনা, কিছু জানেনা, অথচ মায়ের নাম শুনে একটা অপরাধবোধ কাজ করে নিজের প্রতি.....।
মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে ওকে কোলের কাছে টেনে নিলাম, মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, " রুপুসোনার কি মায়ের কথা মনে পড়ছে? একটু কথা বলবে নাকি মায়ের সঙ্গে?ফোন করে দেব?"
মেয়েটা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল " না না পিপি, বাবা বকা দেবে। আর মা তো আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলেনা। মা কোনোদিন আমাকে ফোনও করে না।" কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বলল, "পিপি আমার স্কুলে গেলে না মায়ের জন্য খুব মনকেমন করে জানো। স্কুলে সবার মা নিতে আসে। আমার তো দাদুন যায়। হ্যাপি বার্থ ডে তে আমার মা- কে খুব দেখতে ইচ্ছে করে"..বলে ঠোঁট ফোলাতে গিয়েও সামলে নিল...আমিও দীর্ঘশ্বাসটা চেপে গেলাম। মেয়েটা কবে এত বড় হল!
আমরা দুই ভাইবোন। দাদা আমার থেকে আট বছরের বড়, হাইস্কুল টিচার। বিয়ে হয়েছিল প্রায় বছর দশেক আগে। বৌদি প্রফেশনালি থিয়েটার করত।ষ্টেজ শো, রিহার্শাল, ওয়ার্কশপ, দূর দূরান্তে শো করার জন্য জন্মের পর থেকেই রুপু প্রায় মা ছাড়া। প্রফেশনের পাশাপাশি প্যাশন বলে আমরাও বৌদিকে সবসময় সাপোর্ট দিতাম। দাদাই মেয়েকে প্রায় একা হাতে সামলেছে।মা বিরক্ত হত বলে মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব দাদা খুশিমনে পালন করত।ওর খাবার তৈরী করা থেকে খাবার খাওয়ানো,ন্যাপি বদলানো থেকে ফিডিং বোতল পরিষ্কার করা, রাতের পর রাত জাগা, জ্বোরো কপালে জলপট্টি দিয়ে, সারারাত টেম্পারেচার মেপে সকালে ঘুম চোখে উঠে নাকেমুখে গুঁজে স্কুলে দৌড়ত। হাঁসফাঁস করে ফিরেই আবার মেয়ে নিয়ে পড়ে থাকত। ওর জ্বর,পেটব্যথা,বদহজমে কোথায় কখন কি ওষুধ আছে, কোনটা দরকার সব ছিল দাদার কণ্ঠস্থ। টলমল পায়ে মেয়েকে হাঁটতে শেখানো থেকে শুরু করে ঘোড়া ঘোড়া খেলায় ঘোড়া হওয়া, মেয়ের হাতেখড়ি দেওয়ানো থেকে সরস্বতী পুজোয় প্রথম শাড়ি পড়ানো,চুল বেঁধে দেওয়া সবতেই দাদা সিদ্ধহস্ত। মেয়েরা তো মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে শুরু করে চাইল্ড কেয়ার লিভের সুবিধা পায়। কিন্তু বাবা আর মায়ের জোড়াদায়িত্বের মধ্যে পড়ে দাদাকে কখনও কখনও হাফ পে লিভ নিয়েও সামলাতে হয়েছে। সারাদিন ক্লাস করে স্কুল থেকে সন্ধ্যায় ফিরে মাঝরাত পর্যন্ত যখন গল্প বলে ঘুম পাড়াত,তখন বৌদির প্রোডাকশনের গাড়ি দাঁড়াত দরজার সামনে। গাড়ির শব্দে প্রায় ঘুমিয়ে যাওয়া মেয়ে জেগে উঠে দৌড়ে যেত সদর দরজায়। কিন্তু সারাদিন পর একরত্তি মেয়েটা মায়ের একটু আদর পেতে চেয়েও পেত শুধু বকাবকি, অবজ্ঞা আর অবহেলা। মুখ চুন করে ফিরত বাবার সঙ্গে শোওয়ার ঘরে। তারপর ভোররাত পর্যন্ত আমরা শুনতে পেতাম দুজনের তর্কাতর্কি,দোষারোপ। এভাবেই একসময় বোঝা গেল আর চলছেনা। 'দ্য ম্যারেজ ইস ওভার' বলে বৌদি আলাদা হয়ে চলে গেল অন্য ফ্ল্যাটে, অন্য জীবনে, মেয়ের জন্য বিন্দুমাত্র ভাবনা না রেখে, মাতৃত্বের একফোঁটা দাবী না করেই....কিন্তু ম্যারেজ ওভার হলেও মেয়েকে ফেলে দিতে পারেনি তার বাবা।ঐ মেয়ে আঁকড়ে পরে রইল দাদা।
কলিং বেলের শব্দে আমার চিন্তার তাল কাটল। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দাদা বাজার করে ফিরেছে। সকালে আমরা দুজনেই বেরই বলে মা কে বাজারটা রাতেই করে দিতে হয়। দেখলাম দাদার গায়ের টি শার্ট ঘামে ভিজে জবজবে, চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। দাদা ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে একটা মিল্কি বার নিয়ে রুপুকে দিতে গেল। রুপু ঠোঁট ফুলিয়ে পিছনে ঘুরে দাঁড়াল। দাদাও নাছোড়বান্দা। একটুও রেগে না গিয়ে,একফোঁটাও ধৈর্য্য না হারিয়ে ঠিক এদিক সেদিক করে বুঝিয়ে মেয়েকে কাছে টেনে নিল। কিছুক্ষণ পর আমি রান্নাঘরে চা করতে করতে শুনতে পেলাম বাপ - বেটির খলবল করে কথা বলার আওয়াজ। মান-অভিমান ভাঙার পালা চলছে তাহলে......
প্রচণ্ড ভালোলাগা আর শান্তিতে মনটা হঠাৎ যেন ভালো হয়ে গেল। আমাদের চারপাশে কত মা আছে যারা সন্তানকে মানুষ করছে একেবারে একা হাতে, একার জোরে। তাদের গল্প তো হামেশাই হয়। কিন্তু যেসব বাবারা নীরবে নিশ্চুপে মায়ের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে একান্তে, তারা খবরে আসেনা। মা গর্ভধারণ করে আর পৃথিবীর আলো দেখায় বলেই সে মা, এটা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু শুধু জন্ম দিলেই তো মা হওয়া যায় না! বরং তার পরবর্তী কর্মগুলোর মধ্যে দিয়েই আস্তে আস্তে মা হয়ে উঠতে হয়। তাই সেইসব বাবাদের সিঙ্গেল ফাদার নয় বরং সিঙ্গেল মাদার বলা হোক, যারা মায়ের মত কঠিন কাজকেও সহজ করে নিয়েছে শুধুমাত্র সন্তানকে ভালোবেসে.....কথায় বলে, মা হওয়া কি মুখের কথা!!
ছোট ছোট ফুলগুলো তো পৃথিবীতে নিজেরা আসেনি, আনা হয়েছে বলেই না ওরা এসেছে। পৃথিবীকে রঙিন করেছে। ওদের ভালোবাসুন। সেইসব বাবাদের পাশে থাকুন।কারণ সত্যিই মা হওয়া মুখের কথা নয়।আমরা সবাই দূরে ঠেলে দিলে ওরা যে অসহায় হয়ে যাবে। মরে যাবে সবুজ শৈশবটা। নিজেদের সমস্যা,জটিলতার দায়ভার ওদের ওপর চাপাবেন না। ওদের কাঁধ যে বড্ড নরম। বড্ড অপরিনত। ওরা বইতে পারবেনা। এরাই একদিন মহীরুহ হয়ে বৃদ্ধ বয়সে ছায়া দেবে আপনাকে আমাকে... আমাদের সকলকে।
.বাবারাও সিঙ্গেল মাদার হয়....
🖋 কলমে পার্বতী মোদক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন