"রূপালি পর্দার রহস্যনায়িকা"
রূপের চেয়ে মায়া, কণ্ঠের চেয়ে নীরবতা—এই দুইয়ে মিশে গিয়েছিল এক কিংবদন্তির নাম। তাঁর চুলের ঢেউ, চোখের ভাষা আর মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার দৃশ্যই যেন একরকম বিদ্রোহ।
১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল, অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার গবিন্দপুরে জন্ম রোমার। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী, মা ইন্দিরা দেবী ছিলেন গৃহিণী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে রোমা ছিলেন পঞ্চম। শৈশবে তিনি ছিলেন চুপচাপ, আত্মভোলা আর একটু গোঁয়ার। কথা কম বলতেন, কিন্তু চোখে ছিল বিদ্রোহের আগুন।
পাবনার মেয়েরা যেখানে সেলাই আর রান্না শিখতো, রোমা সেখানে বই পড়ে, আয়নাতে নিজের চোখের ভাষা পড়তো।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগুন লেগে গেল পূর্ববঙ্গে। দাশগুপ্ত পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। তারা চলে আসে কলকাতায়, ঠাঁই হয় ভবানীপুরের এক ছোট বাড়িতে। অর্থকষ্ট, নতুন শহর, অচেনা জীবন—সব মিলিয়ে এক তীব্র ধাক্কা।
এই কলকাতার ভিতরেই ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল এক নায়িকা, যার চোখে তখনো ছিল শুধুই নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে রোমার বিয়ে হয়ে যায় দেবনাথ সেন-এর সঙ্গে, যিনি ছিলেন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আদিনাথ সেনের ছেলে। বিয়ের পর নতুন পরিচয়—সুচিত্রা সেন। এখান থেকেই শুরু হয় বদলের আরেক অধ্যায়।
নতুন সংসার, নতুন শহর আর অজানা এক টান—পর্দার প্রতি, অভিনয়ের প্রতি। দেবনাথ সেন শুরুতে কিছুটা সংশয়ে থাকলেও পরে স্ত্রীকে সাহস দেন। তিনিই সুচিত্রাকে প্রথম নিয়ে যান অভিনয়ের জগতে।
১৯৫২ সালে, মাত্র ২১ বছর বয়সে, ‘শেশ কত দিন’ ছবির মাধ্যমে অভিনয়ে আত্মপ্রবেশ। তবে বড় সাফল্য আসে ১৯৬৩ সালে, ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সঙ্গে জুটি বেঁধে।
১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ' সাড়ে চুয়াত্তর ' সিনেমা তে জুটি বাঁধেন উত্তম কুমার এর সাথে। এটি বক্স অফিসে হিট হয়।
এখান থেকেই জন্ম নেয় বাংলা সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি—উত্তম-সুচিত্রা।
তাদের পর্দার প্রেম ছিল এমন, যা বাস্তবেও অনুভব করতেন দর্শকরা। কিন্তু বাস্তবে? তারা কখনো প্রেম করেননি। সুচিত্রা ছিলেন ততোধিক গম্ভীর, লাজুক এবং নিজেকে গুটিয়ে রাখা মানুষ। এখানেই রহস্যের শুরু।
সুচিত্রা ছিলেন বাংলার প্রথম অভিনেত্রী যিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছিলেন—১৯৬৩ সালে মাদার ইন্ডিয়া-র আগে তিনি 'সাত পাকে বাঁধা' ছবির জন্য মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সম্মানিত হন।
১৯৭২ শিল্পকলায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য পদ্মশ্রী লাভ করেন।
২০১২ চলচ্চিত্র অভিনয়ে আজীবন কৃতিত্বের জন্য বঙ্গ বিভূষণ পুরস্কার ও ২০১৪ সালে ফিল্মফেয়ার ইস্ট লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (মরণোত্তর) জিতেছেন।
তবু এই নারী ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন নিঃসঙ্গ। তিনি মিডিয়া থেকে দূরে থাকতেন, সাক্ষাৎকার দিতেন না, পুরস্কার নিতে যেতেন না।
তাঁর চারপাশে তৈরি হয় এক অদৃশ্য দেয়াল—যার ভেতরে প্রবেশ ছিল সবার জন্য নিষিদ্ধ।
১৯৭৮ সাল। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে, ‘প্রণয় পাসা’ ছবির পর হঠাৎ করেই তিনি ঘোষণা দেন—আর কোনো সিনেমায় অভিনয় করবেন না।
কলকাতা সিনেমা জগত যেন থমকে গেল।
এরপর তিনি সরে গেলেন সম্পূর্ণ গোপন জীবনে। এক আশ্রমিকের মতো জীবন, শুধুই নীরবতা। কেউ জানত না, তিনি কোথায় থাকেন, কী করেন, এমনকি কেমন আছেন।
সুচিত্রা যেন নিজেকে মুছে দিলেন সুচিত্রা থেকেই।
২০১৪ সালের ১৭ জুলাই, ৮৩ বছর বয়সে সুচিত্রা সেন মারা যান।
তাঁর শেষকৃত্যেও ছিল নিষ্ঠুর নির্জনতা। কোনো ক্যামেরা ঢুকতে পারেনি। এমনকি মৃত্যুর পরেও তিনি রেখে গেলেন এক গভীর রহস্য।
তিনি চেয়েছিলেন, মানুষ যেন তাঁকে শুধুই রূপালি পর্দার সুচিত্রা হিসেবেই মনে রাখে। বাস্তবের কোনো ছায়া যেন না পড়ে স্মৃতির ছবিতে।
সুচিত্রা সেন একমাত্রিক নন। তিনি ছিলেন রোমাঞ্চকর, আত্মনিবেদিত, আত্মগোপনে অভ্যস্ত এক চরিত্র। তিনি ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের অপছন্দের জন্য বিখ্যাত, আবার পরিচালক অসিত সেনের ‘জীবনের আলো’ও।
তাঁর জীবন যেন এক অসমাপ্ত চিত্রনাট্য—যার অনেকগুলো পাতা আজও নিখোঁজ।
আর ঠিক সেখানেই তো তৈরি হয় রহস্য, থ্রিল আর বিস্ময়।
সুচিত্রা সেন—একজন মানুষ নন, তিনি এক পুরনো ফিল্ম রীল, যার প্রতিটি ফ্রেমে ছায়া, নীরবতা আর অপার মুগ্ধতা।
জন্ম দিবসে সশ্রদ্ধ প্রণাম এই আইকন কে, বাঙালির মনের মণিকোঠায় আপনি প্রজ্জ্বলিত দীপ হয়ে রয়ে যাবেন আগামী কয়েক শত যুগ।
কলমে ✍️ সুরজ মন্ডল
©️Mr. Hotch Potch
ইতিহাসের নানা অধ্যায় জানতে আমাদের সঙ্গে থাকুন..
আমাদের ইউটিউব চ্যানেল -
https://youtube.com/@talpata_mr.hotchpotch?si=GH6oNo0zh1SSkB8b
WhatsApp Channel
https://whatsapp.com/channel/0029Vaa7cYoJ93wOSMU4ku1I
Follow Us on Instagram
https://www.instagram.com/talpata_history?igsh=Z3Z5N21qNnRsbWxx
#hiatoy #incenthistory #HistoryUncovered #Heroen #SuchitraSen #bengalifilmindustry #tollywood
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন