তিনি ছিলেন সুচিত্রা সেনের প্রথম নায়ক
মনে পড়ে সেই সমর রায়কে?
'সাত নম্বর কয়েদী' (১৯৫৩) ছবিতে রোমান্টিক জুটি ছিলেন সমর রায় -সুচিত্রা সেন । সমর রায় চলচ্চিত্রে যোগ দেন ১৯৪৫ সালের দিকে ।
তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হলো - বর্মার পথে ( ১৯৪৭ ) , মন্দির (১৯৪৭ ) , সাবিত্রী সত্যবান , রাজমোহনের বৌ, সুনন্দার বিয়ে, নিরক্ষর , স্বয়ং সিদ্ধা , অনামী , সাত নম্বর কয়েদী , মধুরাতি ,
চলাচল - প্রভৃতি । 'স্বয়ং সিদ্ধা' ছবিটি ছিল হিন্দি ছবি ,এই ছবিতে সমর রায়ের অসাধারণ অভিনয় দেখে বোম্বের বিখ্যাত অভিনেতা ইয়াকুব ১৯৫১ সালে ছুটে এসেছিলেন কলকাতায় । উদ্দেশ্য ছিল , ইয়াকুবের পরবর্তী ছবিতে সমর রায়কে নায়ক করা । সমর রায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত অসম্ভব জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন ।
'বর্মার পথে' ছবিটি ১৯৪৭ সালে মুক্তি পায় , এই ছবিতে সমর রূপকের চরিত্রে অভিনয় করলেও পাহাড়ি বেদে সম্প্রদায়ের কাছে লালিত পালিত হওয়ার কারণে ওর নাম হয় ঝুমরু । ছবিতে ঝুমরুরূপী সমর রায়কে ভালোবাসে দুই যুবতী - বেশ রোমান্টিক গল্পের এই ছবিটি দেখার স্মৃতি আজও মন থেকে সরে
যায়নি ।
সমর রায় তাঁর যুগে ছিলেন সফল নায়ক, রোমান্টিক
নায়ক । 'বর্মার পথে' ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৫২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'নিরক্ষর' ছবিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্মৃতিরেখা বিশ্বাস, সন্ধ্যারাণী, ছবি বিশ্বাস, ধীরাজ ভট্টাচার্য, অপর্ণা দেবী, আশু বসু, ফণি রায়, সাধন সরকার, নিভাননী দেবী প্রমুখ শিল্পীরা।
১৯৫২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'মধুরাতি' ছবিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন সুপ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় ও গীতশ্রী।
'সাবিত্রী সত্যবান' ছবিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও যমুনা সিংহ । 'সাবিত্রী সত্যবান' ছবিতে সমর রায় ছিলেন সত্যবানের চরিত্রে ।
১৯৪৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'চলার পথে' ছবিতে সমর রায়ের সঙ্গে অভিনয় করেন দেবী মুখার্জি ও বনানী চৌধুরী।
১৯৪৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'হেরফের' ছবিতে সমর রায়ের সঙ্গে অভিনয় করেন - দীপ্তি রায়, স্বাগতা দেবী, সন্ধ্যারাণী, ছায়া চৌধুরী, মায়া দাস, রেখা রায়, অবনী মজুমদার, গোপাল চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রাবতী দেবী প্রমুখ।
১৯৫১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'রাজমোহনের বউ' ছবিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন - জ্যোস্না গুপ্তা, ঝর্ণা দেবী, গৌরী দেবী প্রমুখ। ১৯৫১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'সুনন্দার বিয়ে' ছবিতে সমর রায়ের বিপরীতে ছিলেন অনুভা গুপ্তা। ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'চলাচল' ছবিতে সমর রায়ের সহশিল্পীরা হলেন - অরুন্ধতী দেবী, নির্মল কুমার, অসিতবরণ, তপতী ঘোষ, অনিল চট্টোপাধ্যায়, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, চন্দ্রাবতী দেবী প্রমুখ।
ছবিটি রিলিজের পরে রূপাঞ্জলি'তে লেখা হয়েছিল - 'সমর রায় তাঁর সুন্দর দেহাবয়াব সত্যবানকে যেন জীবন্ত করে তুলেছে ।'
সমর রায় -সুচিত্রা সেন জুটির স্মরণীয় ছবি
'সাত নম্বর কয়েদি'।
সুকুমার দাশগুপ্ত পরিচালিত সাত নম্বর কয়েদি ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল
১৯৫৩ সনের ৭ ফেব্রুয়ারী।
কাহিনি -মণি বর্মা।
প্রযোজনা ও পরিচালনা - সুকুমার দাশগুপ্ত।
গীতিকার- গৌরী প্রসন্ন মজুমদার।
সুরকার - কালিপদ সেন।
চিত্রশিল্পী - বঙ্কু রায়।
সম্পাদনা - শ্রী কমল গাঙ্গুলী।
শিল্পনির্দেশক - শ্রী সত্যেন রায় চৌধুরী।
রূপসজ্জা - শ্রী নিতাই সরকার ও
বসন্ত দত্ত।
সহকারী পরিচালক -
শ্রী নীতিশ রায়, বিমল শী, বিজয় বসু।
নিবেদিত - এস, এম প্রোডাকসন্স।
ভূমিকায় -
জহর গাঙ্গুলী, ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র,
কানু বন্দ্যোপাধ্যায়,
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামলাহা,
প্রভা দেবী, মলিনা দেবী, ছবি রায়, সমর রায়,
মিহির ভট্টাচার্য্য, তপেন, শরৎ, সিদ্ধেশ্বর, নকুল,
বিজয় বসু, আদিত্য, গণেশ, শিবু মুখোপাধ্যায়,
মঞ্জুলা, আশা দেবী, অনিল
এবং
নবাগতা সুচিত্রা সেন।
সাত নম্বর কয়েদি ছবির গান -
১.
সুরধুনী নয় তো নদী ধন্বন্তরি তেল,
যেথা যমে টানে সেথায় হানে
যমের বুকেই শেল
দাদা গো, নিজের চোখেই যাও দেখে এই
ভানুমতীর খেল।
এক শিশিতেই ব্যাধি বালাই
হাঁক ছেড়ে কয় পালাই পালাই
সারবে ব্যামো যে গতিতে ছোটে তুফান মেল
দাদাগো, নিজের চোখেই যাও দেখে এই
ভানুমতীর খেল।
রাখলে ঘরে একটি শিশি
হাসেন দেঁতো খুড়ো বেতো পিসি
আর গয়না চাওয়ার বায়না ভুলে
ভাঙ্গে মানের দেল
ভাঙ্গে বৌয়ের মানের দেল।
মূল্য যে এর এক আধুলি
দাদা গো, যাওনা নিয়ে এই মাধুলি
আর এমন সুযোগ ছাড়া মানেই
একটুতে ট্রেন ফেল।
২.
এই মালা যে চাও
তুমি এই মালা যে চাও
কি দাম দেবে নেবার আগে
একটু ভেবে নাও।
তুমি একটু ভেবে নাও
এ মালা চাই যে দিতে
তুমি কি পারবে নিতে ?
নেবে তো দামটা আগে দাও।
নেবে কি নেবে না তা একটু ভেবে নাও
তুমি একটু ভেবে নাও।
এ মালা আমারই থাক কি লাভ তোমার দিয়ে
আমি তবু থাকব খুশী গন্ধ টুকু নিয়ে,
তার গন্ধ টুকু নিয়ে,
আকাশে যে চাঁদ জাগে
দূরে তা ভালই লাগে
তারে কি চাইলে কাছে পাও?
৩.
আজি এই সন্ধ্যায় বল তো কি মন চায়
চল ঐ বনছায়
যে কথাটি মরমে জেগে আছে সরমে
তোমারে শোনাতে কাছে চাইগো।
গুণগুণ অলি গায় কলি তাই ফুটল
পরাণের বাঁশিটি যে সুরে ভ'রে উঠল
আনন্দ দিল দোল
অনুরাগ হিল্লোল
তুমি শোন আমি গান গাইগো।
পাশাপাশি আজ মোরা জেগে রব দুজনে
মুখরিত হবে প্রেম শপথের কূজনে
জেগে রব দু'জনে,
তুমি আছ পাশে তাই সবই ভাল লাগে আজ
ভূবন ভরিয়া যেন বসন্ত জাগে আজ
এই শুভ লগনে চাঁদ জাগে গগনে
তুমি ছাড়া কেহ মোর নাই গো।
ছবির কাহিনি -
দাগি আসামী সত্যকিংকর জেল থেকে
ছাড়া পেয়ে ফিরছিল ঘরের দিকে ।
পথে চোর ধরার কলরব শুনে তার
পাপজীবনের সাধারণ অভ্যাসে সে গিয়ে লুকালো
এক ঘরে। সে সেখানে পেল
সদ্যমৃতা এক নারীর কাছে এক ফুটফুটে মেয়ে।
সত্যবাবু মেয়েটিকে এনে তুলল তারই রক্ষিতা বিনোদিনীর ঘরে।
মেয়েটিকে পেয়ে বিনোদিনীর
মাতৃহৃদয়ও কেমন নাড়া দিয়ে উঠল,
তাই সে মায়ায় পড়ে গেল শিশুটির।
মেয়েটির নাম রাখা হলো অরুণা।
একদিন সত্যর পেশার কথা নিয়ে ঝগড়া হলো বিনোদিনীর সঙ্গে আর তারই
পরিণামে সে অরুণাকে নিয়ে ঘর বাঁধল অন্যত্র।
সত্য এখন অরুণার পিতা।
মেয়েকে যাতে ছোট না হতে হয়
সে জন্য সে ভদ্র হবার চেষ্টা করে এবং
প্রথমে চাকরি ও পরে ব্যবসা করে
ক্রমে সে ধনী হয়ে উঠল।
নিজের নামটাও দিল সেই সঙ্গে বদলে।
এতদিনে অরুণা বেশ বড় হয়েছে।
সে এখন কলেজে পড়ে।
বিনোদিনী রোজ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে
একবারটি করে দেখে যায় স্নেহে পরা মেয়েটিকে। কলেজের মেয়ে অরুণার সঙ্গে পরিচয় হলো ধনী চন্দ্র কান্ত বাবুর পুত্র রমেনের সঙ্গে।
সত্য জানল তা। সে তাদের বিয়ের কথা
ভাবতেই বিনোদিনীর জন্য মনটা
কেমন করে উঠল।
সে বিনোদিনীর খোঁজ পেল না।
বিনোদিনী গাড়ি চাপা পড়েছে অরুণারই গাড়িতে। বিনোদিনীর মৃত্যুকালে অরুণা জেনেছিল
সে তার মা। অরুণার সঙ্গে রমেনের
বিয়ের রাতে প্রকাশ পেল এককালে
সত্যকিংকর দাগি চোর ছিল।
বাপ ছেলেকে তুলে নিয়ে যেতে চাইলেন।
রমেন পিতার শাসন না মেনে অরুণাকে
বিয়ে করায় চন্দ্রকান্ত তাকে ত্যাজ্যপুত্র করলেন। সত্যকিংকর শপথ করে জানাল
অরুণা তার নিজের মেয়ে নয়,
কুড়িয়ে পাওয়া।
তাই অরুণার কোনো অপরাধ নেই।
সত্য অরুণার পিতৃপরিচয় খুঁজে বার করল
কিন্তু তবুও রমেন,
অরুণার ওপরে সত্যের কোনো অধিকার
মানতে চাইল না। সত্য, রিক্ত সত্য,
ব্যথাহত মনে বেরিয়ে পড়ল নিরুদ্দেশের পথে। অরুণার পিতৃপরিচয় একটি রহস্য সৃষ্ট হয়েছে,
যা এই ছবির একটি সুন্দর রহস্য।
এ ছবিতে রমেনের ভূমিকায় ছিলেন
সমর রায়। আর
নবাগতা সুচিত্রা সেন ছিলেন অরুণার চরিত্রে।
লিয়াকত হোসেন খোকন
LEAQUAT HOSSAIN KHOKON.
ছবি - 'সাবিত্রী সত্যবান' ছবিতে ( ১৯৫২ ) সমর রায়ের সঙ্গে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও যমুনা সিংহ ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন