এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

বৃহস্পতিবার, ৮ মে, ২০২৫

শক্তি সঞ্চয়ের নতুন দিগন্ত: ফিনল্যান্ডের স্যান্ড ব্যাটারি

 শক্তি সঞ্চয়ের নতুন দিগন্ত: ফিনল্যান্ডের স্যান্ড ব্যাটারি


কল্পনা করুন—আপনার বাড়ির পাশে পড়ে থাকা সাধারণ বালি একদিন বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাবে, আর কনকনে শীতের রাতে আপনার ঘর রাখবে গরম? অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? অথচ ফিনল্যান্ডের একদল ইঞ্জিনিয়ার এই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন!


তারা উদ্ভাবন করেছেন "স্যান্ড ব্যাটারি" বা বালির ব্যাটারি—শক্তি সঞ্চয়ের এক আশ্চর্য প্রযুক্তি, যা ভবিষ্যতের শক্তি সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। চলুন, সহজ ভাষায় বুঝে নিই—এই অভিনব প্রযুক্তি আসলে কী, কীভাবে কাজ করে।

.


স্যান্ড ব্যাটারি কী?


প্রথমেই বলা দরকার, এটা কিন্তু আপনার মোবাইল বা রিমোটের ব্যাটারির মত নয়। ওগুলি রাসায়নিক শক্তি জমিয়ে রাখে আর সরাসরি বিদ্যুৎ দেয়। স্যান্ড ব্যাটারি একটু ভিন্ন ধরনের। এটি মূলত একটা বিশাল আকারের "থার্মাল স্টোরেজ"  বা তাপ শক্তি সঞ্চয় ব্যবস্থা। যেখানে রাসায়নিক নয়, জমা থাকে তাপ।


সহজ কথায়, এটি এক ধরনের বড়, ভালভাবে ইনসুলেটেড বা তাপরোধী স্টিলের ট্যাঙ্ক, যার ভেতর ভরা থাকে প্রচুর সাধারণ বালি। উজ্জ্বল রোদ বা প্রচণ্ড বাতাসের সময় সৌর প্যানেল বা উইন্ড টারবাইন থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বালিকে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উত্তপ্ত করা সম্ভব হয়।


এখানে বালি একপ্রকার "তাপীয় ব্যাটারি" হিসাবে কাজ করে—যেমন রাসায়নিক ব্যাটারিতে ইলেকট্রন জমা থাকে, এখানে জমা থাকে তাপ। উত্তপ্ত বালি মাসের পর মাস তাপশক্তি ধরে রাখতে পারে, যা পরে ব্যবহার করা হয় পানি গরম করতে বা ঘরবাড়ি উষ্ণ রাখতে।

.


যেভাবে শুরু হল


এই প্রযুক্তির পেছনে রয়েছে ফিনল্যান্ডের স্টার্টআপ কোম্পানি "পোলার নাইট অ্যানার্জি" (Polar Night Energy)। ফিনল্যান্ডে শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও নিচে নেমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ঘর গরম রাখার জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। আবার, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস, বিশেষ করে উইন্ড পাওয়ার, সব সময় সমানভাবে শক্তি দিতে পারে না। কখনও বাতাস বেশি, কখনও কম। ফলে উদ্বৃত্ত শক্তি ধরে রাখার সস্তা ও কার্যকর উপায়ের অভাব ছিল।


এই বাস্তব সমস্যা থেকেই স্যান্ড ব্যাটারির ধারণা জন্ম নেয়। ২০২২ সালে পোলার নাইট অ্যানার্জি কানকানপা  শহরে "ভাতাজানকোস্কি" নামের একটি পাওয়ার কোম্পানির সঙ্গে মিলে পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক স্যান্ড ব্যাটারি চালু করে।


এই প্ল্যান্টটি এলাকার "ডিস্ট্রিক্ট হিটিং" নেটওয়ার্কে তাপ সরবরাহ করে—অর্থাৎ এলাকার বাড়িঘর, স্কুল, অফিস ইত্যাদি উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে। বর্তমানে জার্মানির কিছু ছোট শহরেও একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে কমিউনিটি হিটিং প্রকল্পের জন্য—যেখানে আবহাওয়া ঠাণ্ডা এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ছে।

.


কাজের পদ্ধতি 


বালি ব্যাটারির কাজ করার পদ্ধতি বেশ মজার এবং তুলনামূলকভাবে সরল। প্রথমে, যখন সস্তায় বা উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ পাওয়া যায় (বিশেষ করে সৌর বা বায়ু বিদ্যুৎ), তখন সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে রেজিস্ট্যান্স হিটারের (এক ধরনের বৈদ্যুতিক হিটার) মাধ্যমে বাতাস গরম করা হয়। এরপর সেই গরম বাতাস পাইপের মাধ্যমে ট্যাঙ্কভর্তি বালির মধ্যে চালনা করা হয়। গরম বাতাসের সংস্পর্শে বালি ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে থাকে এবং তাপশক্তি শোষণ করে নেয়। 


ট্যাঙ্কটি এত ভালভাবে ইনসুলেট করা থাকে যে ভেতরের তাপ সহজে বাইরে বেরিয়ে আসে না, ফলে মাসের পর মাস ধরে তাপ জমা থাকতে পারে। পরে যখন প্রয়োজন হয়, তখন ঠাণ্ডা বাতাস সেই উত্তপ্ত বালির মধ্য দিয়ে চালানো হয়। তখন বাতাস গরম হয়ে ওঠে এবং সেই গরম বাতাস হিট এক্সচেঞ্জারের মাধ্যমে পানি গরম করতে ব্যবহৃত হয়। এই গরম পানি পাঠানো হয় ডিস্ট্রিক্ট হিটিং নেটওয়ার্কে অথবা ব্যবহৃত হয় শিল্প কারখানার বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়।


মূলত, এখানে বিদ্যুৎ সরাসরি জমিয়ে না রেখে, তা প্রথমে তাপে রূপান্তর করে জমিয়ে রাখা হয়—কারণ তাপশক্তি সঞ্চয় করা অনেক বেশি সাশ্রয়ী ও সহজ, বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে।

.


বর্তমান অবস্থা


ফিনল্যান্ডের কানকানপা শহরের প্ল্যান্টটি সফলভাবে কাজ করছে এবং এটি প্রমাণ করেছে যে এই প্রযুক্তি বাস্তবে কার্যকর। এটি প্রায় ৮ মেগাওয়াট-আওয়ার তাপশক্তি সঞ্চয় করতে পারে, যা দিয়ে বেশ কিছু বাড়িঘর কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত গরম রাখা সম্ভব। পোলার নাইট অ্যানার্জি এখন বৃহত্তর স্কেলে, ২০ থেকে ৫০ মেগাওয়াট-আওয়ারের মত বিশাল স্যান্ড ব্যাটারি তৈরির পরিকল্পনা করছে। 


শুধু ফিনল্যান্ড নয়—কানাডা, জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থাও এখন এই প্রযুক্তির ওপর গবেষণা শুরু করেছে। ভবিষ্যতে, বড় বড় ডেটা সেন্টারগুলিতেও স্যান্ড ব্যাটারি ব্যবহার করা হতে পারে, যাতে সার্ভারের জন্য প্রয়োজনীয় ঠাণ্ডা বা গরম তাপমাত্রা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

.


স্যান্ড ব্যাটারির সুবিধা 


স্যান্ড ব্যাটারির বেশ কিছু দারুণ সুবিধা রয়েছে, যা একে ভবিষ্যতের শক্তি সঞ্চয় প্রযুক্তির জন্য বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এর প্রধান উপাদান হল সাধারণ বালি—যা সারা পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে মেলে এবং তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত সস্তা। তাই স্যান্ড ব্যাটারির উৎপাদন খরচ অনেক কম।


এছাড়া এর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতাও উল্লেখযোগ্য। রাসায়নিক ব্যাটারির মত বার বার ব্যবহারে কার্যক্ষমতা কমে আসে না—বরং বালি হাজার হাজার বার উত্তপ্ত ও ঠাণ্ডা হতে পারে, কার্যক্ষমতার কোনো বড় ধরনের ক্ষতি ছাড়াই। ফলে এটি দীর্ঘমেয়াদে একটি টেকসই সমাধান।


নিরাপত্তার দিক থেকেও স্যান্ড ব্যাটারি এগিয়ে। এতে বিস্ফোরণ বা আগুন লাগার ঝুঁকি অত্যন্ত কম, তাই এটি অধিকতর রিস্ক-ফ্রি প্রযুক্তি হিসাবে বিবেচিত। 


শুধু তাই নয়, এটি দীর্ঘ সময় ধরে তাপ সঞ্চয় করতে সক্ষম। ফলে গ্রীষ্মকালে উৎপন্ন অতিরিক্ত সৌরশক্তি শীতকালে ব্যবহার করা সম্ভব, যা মৌসুমভিত্তিক শক্তি চাহিদা মেটাতে বিশেষভাবে কার্যকর।


সবচেয়ে বড় কথা, স্যান্ড ব্যাটারির ব্যবহার বহুমুখী। এটি শুধু ডিস্ট্রিক্ট হিটিং নেটওয়ার্কে নয়—খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, টেক্সটাইল শিল্প, কেমিক্যাল উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো যেতে পারে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে এবং রাসায়নিক ব্যাটারির কার্যক্ষমতা দ্রুত কমে আসে, সেখানে স্যান্ড ব্যাটারি আরও বেশি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসাবে কাজ করতে পারে।

.


চ্যালেঞ্জ বা সীমাবদ্ধতা


অবশ্য, সব প্রযুক্তির মত স্যান্ড ব্যাটারিরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা হল সঞ্চিত তাপকে আবার বিদ্যুতে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে এর তুলনামূলক কম দক্ষতা। যদিও তাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, এই প্রক্রিয়ায় বেশ খানিকটা শক্তি নষ্ট হয়। তাই এটি সরাসরি বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে তাপ সরবরাহের জন্যই বর্তমানে বেশি কার্যকর। আরেকটি বিষয় হল এর আকার—স্যান্ড ব্যাটারি বেশ বড় আকারের হতে পারে, ফলে এটি স্থাপনের জন্য তুলনামূলক বেশি জায়গার প্রয়োজন হয়। 


এছাড়া, এর কার্যকারিতা অনেকাংশে অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। যদি কাছাকাছি কোনো ডিস্ট্রিক্ট হিটিং নেটওয়ার্ক বা বড় শিল্প কারখানা থাকে যেখানে উৎপন্ন তাপ সরাসরি ব্যবহার করা যায়, তবেই এটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়।


আধুনিক শহরগুলিতে যেখানে জমি কম এবং শক্তির চাহিদা বেশি, সেখানে স্যান্ড ব্যাটারি স্থাপনের জন্য দক্ষ পরিকল্পনা প্রয়োজন হবে।

.


ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা


স্যান্ড ব্যাটারির ভবিষ্যৎ খুবই আশাব্যঞ্জক। গবেষকরা এখন আরও বড় ট্যাঙ্ক নির্মাণ, উন্নত ইনসুলেশন এবং তাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দক্ষতা বাড়ানোর কাজ করছেন। বিশেষ করে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে—যেখানে দিনে প্রচুর সৌর শক্তি মেলে কিন্তু রাতে দ্রুত ঠাণ্ডা পড়ে—স্যান্ড ব্যাটারি সস্তা ও নির্ভরযোগ্য শক্তি সঞ্চয়ের জন্য অসাধারণ সমাধান হতে পারে।


বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মত এলাকায়, যেখানে শীতকালে তাপমাত্রা কমে যায়, সেখানে দিনে সোলার ফার্মের বাড়তি বিদ্যুৎ বালিতে জমিয়ে রাতের জন্য ঘর গরম রাখা সম্ভব হবে।


স্যান্ড ব্যাটারি হয়ত এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠেনি, কিন্তু নবায়নযোগ্য শক্তির যুগে এটি এক যুগান্তকারী সমাধান হতে চলেছে।


#বালি #ব্যাটারি #শক্তি

কোন মন্তব্য নেই:

রাত ৮ টা ৩০ মিনিটের সংবাদ। তারিখ:  ১৩-১২-২০২৫ খ্রি:।

 রাত ৮ টা ৩০ মিনিটের সংবাদ। তারিখ:  ১৩-১২-২০২৫ খ্রি:। আজকের শিরোনাম: যথাযথ মর্যাদায় আগামীকাল দেশে পালিত হবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দুর্বৃত্তদ...