সফলতার গল্প: বৃদ্ধ চাষী ও তার কৃষিবিদ পুত্র
গ্রামের সীমানায়, দূরে এক কাঁচা পথ ধরে যাওয়া যায় একটি ছোট্ট, নির্জন বাড়িতে, যেখানে বসবাস করতেন বৃদ্ধ চাষী আব্দুল হাকিম। এক সময়ের শক্তিশালী কৃষক, যিনি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সংসার চালাতেন, আজ বয়সের ভারে ধীরে ধীরে ক্লান্ত। তাঁর কৃষি জীবন ছিল সংগ্রামী, যেখানে এক ফসল শেষ হলেই আবার নতুন করে শুরু করতে হতো। জমির খরা, বৃষ্টির অভাব, সময়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে করতে যখন তার শরীর আর মন অতীতের মতো তীক্ষ্ণ ছিল না, তখনই তিনি একটি স্বপ্ন দেখেন—তাঁর সন্তান, যারা শহরে পড়ালেখা করছে, তাদের মাধ্যমে কৃষির নতুন সম্ভাবনা দেখতে চান।
আব্দুল হাকিমের একমাত্র পুত্র, সেলিম, ছিল মেধাবী। ছেলেটি ছোট থেকেই পড়াশোনায় আগ্রহী ছিল। তার স্বপ্ন ছিল কৃষিতে নতুন কিছু করার, আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে ছিল তার কঠোর পরিশ্রম। বাবা আব্দুল হাকিম কৃষির কষ্টকর দিনগুলো পেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু তিনি জানতেন, উন্নতির জন্য কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। তাই, তিনি একদিন সেলিমের কাছে এসে বললেন, "বাবা, আমি তো জানি শুধু কৃষির মাটি আর শ্রমে তো জীবন চলে না। কিছু নতুন ভাবনা, কিছু নতুন জ্ঞান লাগবে।"
তবে, সেলিম তার বাবা আব্দুল হাকিমের কথা বুঝতে শুরু করে, এবং একদিন সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে কৃষিবিদ হবে। স্কুল ও কলেজে কঠোর পরিশ্রমের পর সেলিম কৃষিবিদ হিসেবে পড়াশোনা শেষ করল এবং দেশে ফিরে এল। তার চোখে ছিল এক নতুন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। দেশে ফিরে আসার পর সেলিম বাবার কাছে আসেন এবং তাকে আধুনিক কৃষির প্রযুক্তি, নতুন পদ্ধতি, এবং উন্নত ফসল চাষের উপায় জানাতে শুরু করেন। বাবা প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়েছিলেন। তাঁর পুরোনো অভ্যাস, পুরোনো পদ্ধতি ছিল তার কাছে সবচেয়ে কার্যকরী। কিন্তু ছেলের পরামর্শ গ্রহণে তার কোনো সংকোচ ছিল না।
সেলিম বাবাকে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, টেকনিক্যাল ব্যবস্থাপনা, জল সংরক্ষণ, ফসল রোটেশন, এবং পোকামাকড় দমনের নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত শিখিয়ে দেন। এই পরিবর্তনগুলোতে প্রথমে অবাক হলেও, আব্দুল হাকিম বাবা মেনে নেন। ছেলের সঙ্গে কাজ করার এক নতুন অভিজ্ঞতা ছিল তার জন্য।
এভাবে, এক বছরের মধ্যে, পুরোনো ও নতুন প্রযুক্তির সমন্বয়ে শুরু হলো এক নতুন ধরনের চাষ। সেলিম তার বাবাকে জানাল যে, এখন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর মাধ্যমে তারা খরার মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। সেই সঙ্গে, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে খরচও কমে যাবে এবং ফলন দ্বিগুণ হতে পারে।
বৃদ্ধ আব্দুল হাকিম তার পুরনো জমিতে নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে একে একে অনেক ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি দেখলেন। প্রথমে আলু, তারপর গম, সেজে ধান—সব ফসলের ফলন বেড়ে গেল। তাছাড়া, সেলিমের সাহায্যে তারা আরও একাধিক ফসলের সরবরাহ বাজারে পাঠাতে শুরু করল। আর সেলিমের পরামর্শে, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে জমির মাটির স্বাস্থ্যও ভালো হয়ে উঠল।
কৃষির এই নতুন উপায়গুলো বেছে নেওয়ার ফলে, আব্দুল হাকিমের পরিবারের অবস্থা পাল্টে গেল। মাটির ওপর এক নতুন বিশ্বাস জন্মাল। কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ও সেলিমের পরামর্শে তারা জানলেন, শুধুমাত্র পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়—সঠিক জ্ঞান ও উপায় প্রয়োজন উন্নতির জন্য।
আজ, আব্দুল হাকিমের দিনগুলো পাল্টে গেছে। আর তার চোখে আনন্দের আলো। তিনি জানতেন না যে, তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তিনি আধুনিক কৃষির সাথে পরিচিত হবেন। তবে তাঁর ছেলে, সেলিম, তাকে কৃষির নতুন দিশা দেখিয়েছে। এখন, কষ্টের দিনগুলি যেন সত্যিই ফুরিয়ে এসেছে।
তার বয়স বাড়লেও, আব্দুল হাকিমের মনে সেই নতুন দিনের চিত্র স্পষ্ট। তিনি মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন—"অতীতের কষ্টের পর, এখন সুখের দিন। সেলিমের কঠোর পরিশ্রম, আধুনিক চিন্তাধারা, এবং কৃষির নতুন প্রযুক্তি যে আজ আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় দান।"
শিক্ষা:
এমনকি কঠোর পরিশ্রমের পরেও, নতুন প্রযুক্তি এবং সঠিক জ্ঞান গ্রহণ জীবনের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। আগামীর উন্নতির জন্য পুরনো চিন্তা থেকে বের হয়ে, নতুন ধারায় কাজ করতে হবে।
লেখক: আলমগীর হোসেন শিশির
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন