মানুষের ভেতরের উদ্ভাবনী শক্তি কখনো পড়ালেখার জন্য থেমে থাকে না। মানুষের পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তা প্রকাশিত হয় যা প্রমাণ করলেন রাজশাহীর হাফিজ উদ্দিন।
পড়ার ইচ্ছে ছিলো খুব তবুও বড় ভাইয়ের কথায় সপ্তম শ্রেণির পর কলম ছেড়ে হাতে তুলে নেন লাঙল। লাঙলেই ফলিয়েছেন সোনা। এখন তার জায়গা-জমি, সুনাম সব আছে। ছোট ভাইয়কে পড়িয়েছেন বাংলাদেশের শেষ পর্যন্ত।
নিজের চেষ্টায় সংকরায়ণের মাধ্যমে পেয়েছেন ছয় জাতের বীজ যার নামকরণ করেছেন তিনি নিজে। এগুলো হচ্ছে সম্রাট, সুপার গোল্ড, সুপার কিং, মহারাজ,রেশমা সুপার ও কুইন-তাহেরপুরী। এর মধ্যে রেশমা সুপার বীজের নামকরণ করেছেন তাঁর প্রয়াত স্ত্রীর নামে। দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ১৪ জেলায় ছড়িয়ে আছে সেই পেঁয়াজবীজের বাজার। যেসব জেলার মধ্যে রয়েছে রাজশাহী, পাবনা, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, মাগুরা, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, লালমনিরহাট এবং পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও বগুড়া জেলার কিছু অংশ।
এই বীজের বৈশিষ্ট্যঃ
সাধারণ পেঁয়াজ সহজে পচে যায়। চাতালে বেশি দিন টেকে না। একাধিক কন্দবিশিষ্ট হয়, ফেটে যায়। সংকরায়ণের মাধ্যমে পাওয়া হাফিজের বীজের পেঁয়াজ হয় এক কন্দবিশিষ্ট, এক মাপের ও চাতালে টেকে বেশি দিন। তাই চাষিরা ঝুঁকেছেন তাঁর বীজের দিকে। গত বছর হাফিজ উদ্দিনের উৎপাদিত পেঁয়াজবীজের পরিমাণ ছিল ২৯ মেট্রিক টন। এবারের লক্ষ্যমাত্রা ৪০ মেট্রিক টন।
তাঁর রয়েছে ৩৫০ কন্টাক্ট ফারমার (চুক্তিবদ্ধ চাষি)। হাফিজ উদ্দিন সেই চাষিদের বপনের জন্য বীজ দেন, বিনা সুদে ঋণ দেন। তাঁদের উৎপাদিত পেঁয়াজবীজ নিয়েও চাষির দুশ্চিন্তা থাকে না। সব বীজ তিনিই নগদ টাকায় কিনে নেন। এভাবে তিনি নিজের পাশাপাশি দিন বদলে দিয়েছেন ভিটেমাটিহীন শতাধিক চাষির। কেউ জায়গাজমি কিনছেন, কেউ করেছেন পাকা ঘরবাড়ি।
হাফিজ উদ্দিন যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ তা বোঝা যায় তার বীজের স্বকীয়তা রক্ষার মাধ্যম থেকে।
বীজের স্বকীয়তা রক্ষার জন্য হাফিজ উদ্দিন চাষের সময় গোপনীয়তা রক্ষা করেন। মাঠে যাঁরা চাষ করেন, তাঁরা বলতে পারেন না তিনি কোন জাতের বীজ ফলাচ্ছেন। তাঁকে শুধু একটি কোড নম্বর দেওয়া হয়। একমাত্র হাফিজ উদ্দিনই জানেন, কোন কোডে কী বীজ হবে। আবার নির্দিষ্ট একটি এলাকায় তিনি বীজ চাষ করেন না। ঠাকুরগাঁও থেকে রাজশাহী ও কুষ্টিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে তাঁর সাড়ে ৩০০ চাষির জমি। এটা করেন প্রথমত, উপযোগী মাটি আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য। তিনি মাটি হাতে নিলেই বলে দিতে পারেন, ওই মাটিতে ভালো পেঁয়াজ হবে কি না। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ একসঙ্গে সব এলাকায় হয় না। এ জন্য তাঁর খামার দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে ছড়ানো। একটি এলাকায় দুর্যোগ হলেও অন্য এলাকার বীজ তাঁকে বাঁচায়।
হাফিজ উদ্দিন প্রথমে ধান চাষ করতেন। এ সময় মোহনপুর উপজেলার বেলনা গ্রামের মফিজ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি পেঁয়াজবীজের চাষ করতেন। একদিন হাফিজ তাঁর কাছে গিয়ে পেঁয়াজবীজের আবদার করলেন। মফিজ উদ্দিন পরের মৌসুমে হাফিজকে সাড়ে সাত কেজি পেঁয়াজ দেন। আর এখান থেকেই শুরু তার পেঁয়াজ বীজ চাষের।
যেভাবে বাজার দখল করলেনঃ
২৫ বছর আগের কথা। ৫মণ পেয়াজ বীজ হয়েছে তার। প্রতি কেজি ৫০০টাকা দরে বিক্রি জরছিলেন স্থানীয় বাজারে। এক প্রতিবেশী ১০০টাকা বেশি দরে ৬০০টাকায় বীজ কিনে তার শ্বশুরবাড়ির এলাকা পাবনায় বিক্রি করেন সে বীজ। কিছুদিন পর ৮০০টাকা কেজিতে বীজ কিনতে চান সেই প্রতিবেশী। এবার হাফিজ উদ্দিন শর্ত দিয়ে বসেন তিনিও যাবেন পাবনায়। পাবনায় গিয়ে দেখেন সবার মুখে তার বীজের কথা। এরপর সব বীজ বিক্রির দায়িত্ব দিয়ে আসেন সেখানকার এক দর্জিকে এবং বলেন বীজ থেকে চারা গজালে টাকা নিবেন নয়তো না। কিছুদিন পর খবর আসে বীজ থেকে ভালোই চারা এসেছে পাবনার লোকেরা খুশি হয়ে তাকে আড়াই হাজার টাকা কেজিতে বীজের দাম দেন। পাবনার বাজার চলে আসে তার হাতে এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
বীজের চাহিদা এত বেড়ে যায় যে হাফিজ উদ্দিন ‘কন্টাক্ট ফার্মিং’ শুরু করেন। চাষিদের বপন করার জন্য পেঁয়াজ দেন। বিনা সুদে ঋণ দেন। পেঁয়াজবীজ উঠলে তিনি সব কিনে নেন। তাঁদের নিয়ে মাঠ দিবস করেন। মৌসুম শেষে শহরের বড় হোটেলে অনুষ্ঠান করে দক্ষ চাষিদের পুরস্কৃত করেন। সেখানে বিশেষ ভোজের ব্যবস্থাও থাকে।
হাফিজ উদ্দিনের বাড়িতে যাওয়ার কোনো সরকারি রাস্তা ছিল না। তিনি নিজে জায়গা কিনে রাস্তা তৈরি করেছেন। উপকৃত হয়েছেন পাড়ার সব মানুষ। তাঁর দোতলা বাড়ির নিচতলা যেন একটি কারখানা। বীজ তোলার মৌসুমে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশত শ্রমিক কাজ করছেন। কেউ প্যাকেটে ভরছেন, কেউ প্যাকেটের মুখ সেলাই করছেন; কেউ গ্রেডিং মেশিনে, কেউ কৌটার মুখে সিল মারছেন—সে এক কর্মযজ্ঞ।
হাফিজ উদ্দিনের মতো মানুষের জন্ম হোক বাংলার ঘরে ঘরে। যারা নিজের মেধা ও শ্রম খাটিয়ে উপকৃত হবেন নিজে এবং পাশাপাশি উপকৃত করবেন অন্যকেউ।
তথ্যসূত্র: প্রথমআলো।
#পেয়াজ_বীজ #ছয়_জাতের_পেয়াজ_বীজ
(অনুমতি ছাড়া রিপোস্ট করবেন না)
#বাংলার_তথ্যপট (বিস্তারিত জানুন কমেন্টে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন