কুড়িগ্রাম জেলা পোস্ট ১১
চিলমারী উপজেলা
নামকরণ
চিলমারী উপজেলার নামকরণ নিয়ে নানা জনশ্রুতি আর কিংবদন্তি ছড়িয়ে থাকায় কোনটি সঠিক তা স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।
আজ থেকে কয়েক বছর পূর্বে চিলমারীর অধিকাংশ ভূ-খন্ডই ছিলো বালু দিয়ে ঢাকা।তখন এখানে প্রচুর চিনা বাদাম আবাদ হতো।এই কারণে নাকি এই এলাকার নামকরণ হয়েছিলো চীনামারী।এখানে মারী শব্দটির অর্থ জায়গা বা স্থান।সেই চীনামারী কালের পরিবর্তে আজকের চিলমারী শব্দে পরিণত হয়েছে।
আরো জানা জায় এককালে অত্র এলাকায় চিলা পাখির প্রচুর উপদ্রব দেখা দিয়েছিলো।ধানী বা আবাদী জমিতে দল বেঁধে চিল পাখও উড়ে আসতো। নষ্ট করতো হাজার হাজার একর আবাদী জমির ফসল।চিলের উপদ্রপে হাটে বাজারে বস্তিতে কেউ থাকতে পারতো না।সর্বত্রই চিল আতঙ্ক জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো।এসকল চিল পাখি ব্রক্ষ্মপুত্র উপকূলে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতো, বাস করতো বাঁশ ঝাড়ে,আম বাগান অথবা বটবৃক্ষের ডগায়।জনশ্রুতি রয়েছে যদি কোনো মানুষ ভুলেও একটি চিল পাখিকে হত্যা করেছে তো আর রক্ষা নেই।কোথা থেকে যেনো সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতো হাজার হাজার চিল পাখি।ছয় সাত দিন ধরে অত্যাচার চলতো ঐ মানুষটির বাড়ীর উপর।
উপদ্রপের প্রতিকার চেয়ে তারা আবেদন করলো ব্রিটিশ সরকারের কাছে।ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত এলো চিল পাখিগুলোকে হত্যা করার।এই সিদ্ধান্তের বার্তাটি পৌঁছে গেলো কুড়িগ্রামের বিভিন্ন এলাকায়।তাই তারা সংবাদ পাওয়া মাত্র তীর ধনু নিয়ে দল বেঁধে ব্রিটিশ সরকারের প্রেরিত বন্দুকধারী সৈনিকের পিছু পিছু ছুটে এলো চিলমারী থানার মানুষগুলোকে চিল পাখির হাত থেকে নিস্তার দেওয়ার জন্য। দল বেঁধে মানুষের ঢল নামলো চিলমারী থানার আনাচে-কানাচে।দল বেঁধে তীর ধনু হাতে নিয়ে লোকজন যখন চিলমারীর দিকে ছুটে আসছিলো পথিমধ্যে অনেক না জানা লোক যখন দল বেঁধে এতগুলো লোককে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো আপনারা এভাবে কোথায় যাচ্ছেন?
তখন ঐ মিছিল থেকে একটি উত্তর ভেসে আসতো চলো চলো "চিল-মারী" শ্লোগানের মতো।এই শ্লোগান থেকেই নাকি চিলমারী শব্দের উৎপত্তি হয়েছে এবং এলাকার নামকরণ করা হয়েছে "চিলমারী"।
একসময় ব্রক্ষ্মপুত্র নদের উপকূল ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল এক নদী বন্দর।বড় নৌকা আর জল জাহাজ ভীরতো এই নদী বন্দরটিতে।মালামাল খালাস করা হতো আবার জাহাজে নতুন মাল ভরে পারি জমাতো অন্য বন্দরের পানে।ঐ সময় ব্রিটিশ প্রশাসন কর পরিশোধ করবার জন্য এই বন্দরটিতে একটি কাস্টম অফিস স্থাপন করেছিলেন।কাস্টম অফিসার যিনি ছিলেন তিনি কর পরিশোধ হওয়া মাত্রই মালের উপর সিল মেরে দিতেন।সেই সিল মারা দেখে অনেক অশিক্ষিত লোক তখন এই কাস্টম অফিসটিকে সিল-মারী অফিস হিসেবে চিনতো।এই সিল-মারী কালের বিবর্তনে আজকের চিলমারী নামকরণ হয়ে গেছে।লেখক মোস্তফা তোফায়েল হোসেন বলতে চেয়েছেন এই সিল মারার জায়গা থেকে চিলমারীর নামকরণ করা হয়েছে।
অবস্থান ও আয়তন
চিলমারী উপজেলার আয়তন ২২৪.৯৬ বর্গ কিলোমিটার। ২৫°২৬′ থেকে ২৫°৪০′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৩৮′ থেকে ৮৯°৪৮ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।
উত্তরে উলিপুর উপজেলা, দক্ষিণে চর রাজিবপুর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে রৌমারী ও চর রাজিবপুর উপজেলা, পশ্চিমে উলিপুর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা।
১৮৫০ সালে চিলমারী থানা গঠন করা হয় এবং ১৯৮৩ সালে থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়।
প্রশাসনিক অঞ্চল
সংসদীয় এলাকা ১ টি, ইউনিয়ন ৬ টি, মৌজা ৪৮ টি, গ্রাম ১৩৩ টি।
জনসংখ্যা
চিলমারী উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১২২৮৪১ জন। পুরুষ ৫৯৪১৪ জন এবং মহিলা ৬৩৪২৭ জন।
যাতায়াত
পাকা রাস্তা ২৫.৭৬ কিলোমিটার, আধা পাকা রাস্তা ২.২৮ কিলোমিটার, কাঁচা রাস্তা ১১৩.৯ কিলোমিটার, রেলপথ ৩.৫ কিলোমিটার এবং নৌপথ ১৭ ন্যাটিক্যাল মাইল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
শিক্ষার গড় হার ৫০%, এখানে কলেজ রয়েছে ৪ টি,মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৬ টি,প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮৬ টি,কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২ টি,ভোকেশনাল স্কুল ৩ টি এবং মাদ্রাসা ৩০ টি
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
মসজিদ ১৪৫ টি,মন্দির ১০ টি।
সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান
ক্লাব ১৫ টি,লাইব্রেরি ৪ টি,সিনেমা হল ১ টি,সংস্কৃতির সংগঠন ৪ টি,খেলার মাঠ ৬ টি।
নদ নদী ও জলাশয়
ব্রক্ষ্মপুত্র নদ, তিস্তা,উদনার বিল,চাচলার বিল,মাগুড়ার বিল,শৌলধুকরীর বিল,হরিন্যার বন্দ ও পেদি খেওয়ার বিল।
অর্থনীতি
জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি ৬৭.৮৫%।আবাদি জমির পরিমাণ ১৫০০৩ একর।
অর্থকারী ফসল ধান,পাট,গম,সরিষা,আলু বাদাম তামাক, ভুট্টা, শাকসবজি ইত্যাদি।
বিলুপ্ত প্রায় ফসল আলু,অড়হর।
প্রধান রপ্তানি দ্রব্য পাট
প্রধান ফল আম,কাঁঠাল, জাম,পেঁপে, কলা,পেয়ারা।
স্বাস্থ্যকেন্দ্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১ টি,উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ১ টি,পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক ৩ টি,মাতৃসদন ১ টি,ছিন্নমুকুল কর্তৃক পরিচালিত স্বাস্থ্য কেন্দ্র ১ টি,কমিউনিটি ক্লিনিক ১২ টি।
পানীয় জলের উৎস
চিলমারী উপজেলায় নলকূপ ৯৬.২%, ট্যাপ ০.১% এবং অন্যান্য ৩.৭%।
স্যানিটেশন
এ উপজেলায় ৫৯.৩% পরিবার স্বাস্থ্যকর ল্যাট্রিন ব্যবহার করে এবং ২৫.৯% পরিবার অস্বাস্থ্যকর ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। ১৫.৮% পরিবারের কোনো ল্যাট্রিন সুবিধা নেই।
বিদ্যুৎ ব্যবহার
চিলমারী উপজেলায় সবকটি ইউনিয়ন পল্লিবিদ্যুৎতায়ন কর্মসূচীর আওতাধীন। তবে ২৩.৩% পরিবারের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
হাট বাজার, মেলা
হাট ৬ টি ও মেলা৪ টি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাঁচকোল হাট,রাণীগঞ্জ হাট,বালাবাড়ী হাট,জোরগাছ হাট এবং অষ্টমী মেলা,বালাবাড়ী মেলা,বারুনী মেলা,ও দুর্গাপূজার মেলা।
শিল্প কারখানা
স' মিল,ধানকল,ওয়েল্ডিং ইত্যাদি।
কুটির শিল্প, স্বর্ণ শিল্প, মৃৎশিল্প,লৌহ শিল্প, পাট শিল্প,বুনন শিল্প,নকশীকাঁথা, কাঠের কাজ ও বাঁশের কাজ।
মৎস গবাদিপশু ও হাঁস মুরগির খামার
গবাদি পশুর খামার ৯ টি ও হাঁস মুরগির খামার ১৬ টি।
দর্শনীয় স্থান
চিলমারী বন্দর, ব্রক্ষ্মপুত্র নদ, উদুনা-পুদুনা বিল,উষারাণীর বাড়ী( রাণীগঞ্জ), রাজার ঘাট(রাণীগঞ্জ), ভক্তিভিটের ঘাট(কাঁচকল),বাহারের ঘাট,আখালুর ঘাট,তেলিপাড়া ব্রিজ(হাইওয়ে),তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ( মুঘল আমল),কালী মন্দির ও শিব মন্দির।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই উপজেলার বেশ সংখ্যক ব্যক্তি ব্রিটিশ বিরোধী স্বরাজ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন।এদের মধ্যে আবদুল মজিদ,পরেশ চন্দ্র মল্লিক,নরেনকুমার ঠাকুরের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়।পরেশচন্দ্র মল্লিক ধরা পরেন ও আন্দামানে নির্বাসিত হয়।
১৯৭১ সালের ২০ মে মুক্তিযুদ্ধে সময় পাকসেনারা এ অঞ্চলের ৩০ জনকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের তীরে হত্যা করে।১৯৭১ সালের ১৭ ই অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম চাঁদের নেতৃত্বে ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে পাকবাহিনীর লড়াই হয়।এ লড়াইয়ে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং চিলমারী থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দক্ষলে আসে।এই উপজেলার ব্রক্ষ্মপুত্র নদের পাড়ে একটি বদ্ধভুমি রয়েছে।
এনজিও ব্রাক,কারিতাস,গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা।
তথ্যসূত্র ও ছবি : গুগল, ইন্টারনেট