“আয় মা/গী! আমার সাথে আয়। এলাকার লোকেরে দেখাবি আমার স্বামী তোরে কোনে কোনে আদর দিছে। আয়!”
“ছাড়ো আপা। দোহাই লাগে আল্লাহ'র।”
“না না, কেরে ছাড়তাম? আমার স্বামীর নামে ওতো বড় অভিযোগ উঠাছত এহন প্রমাণ দিবি না? তোরে দেহাইতেই হইবো!”
পাশের বাড়ির ওমন কথাবার্তা শুনে পিঠা বানানো রেখে দৌড়ে সে বাড়িতে চলে গেল মা-কাকিমারা। কিন্তু আমি কিংবা আমার বোনেরা উঠে যাওয়ার সাহস পেলাম না। পারিবারিক শিক্ষা টা একটু খানি বেশিই! কথিত আছে, ‘মা-কাকিমা'রা কথা বললে সেথায় থাকতে নেই।’ তাই আমিসহ সকলেই পূর্ণ মনযোগ দিলাম পিঠা বানাতে।
মনযোগের ব্যাঘাত ঘটলো যখন, তাদের মারধর আমাদের বাড়িতে এসে পৌঁছুলো। তাসলি কাকি শিখা কাকির চুলের মুঠি ধরে টেনে টেনে আমাদের উঠোনে আনছেন। আমরা বোনেরা সবাই উঠে গিয়ে জানালা, পর্দা আর দরজার আড়ালে দাড়ালাম। ফাক ফোকড় দিয়ে বাহিরের ঘটনা দেখতে থাকলাম। পাশেই ওনার স্বামী হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছেন আর বলছেন,
“হয়েছে তাসলি! আর মেরো না। ও যেহেতু সবাইকে দেখাতে চাচ্ছেনা তখন ধরে নাও আসলেই আমি ওটা করিনি। ছেড়ে দাও তাসলি।”
“না! ও তো নিজের মুখে স্বীকার করেনি। আগে স্বীকার করুক, তারপর ওকে আমি ছাড়বো। সাহস কত বড়! আমার স্বামীর ভাগ নিতে চায়! কলিজা কেটে কুত্তাকে খেতে দেবো আমি। ”
তাসলি কাকি রিতীমত কাঁপছে। গাঁয়ের প্রচণ্ড রাগী মহিলাদের মধ্যে ওনার নাম টপে। আর ওনার স্বামী কে নিয়েই কিনা অভিযোগ! তাসলি কাকি একটু বেখেয়ালি হতেই শিখা কাকি একটা ঝাড়া মেড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন। গা থেকে সরে যাওয়া ওড়না টা আগে ঠিক করে নিলেন। তারপর এলোমেলো চুলগুলো পেছন দিকে নিয়ে বড় একটা শ্বাস নিলেন। মাথা দুএকবার উপর-নিচ করে চেচিয়ে বললেন,
“কেন আমি স্বীকার করবো না তোমার স্বামী আমাকে ভোগ করেছে তাও আমার স্বামীর অনুপস্থিতি তে, আমার অনুমতি ছাডা!”
তেঁতে এগিয়ে আসে তাসলি কাকি। শিখা কাকির মুখে পিঞ্জা মেরে বলে,
“আরেকটা কথা বলবি তো তোর জিভটাই টেনে ছিড়ে ফেলবো। বে/শ্যা কোথাকার! তোর অনুমতি ছাড়া না? তুই যে কি ন/ডি এইডা কি কেউ জানেনা? আমার স্বামীরেই কেন টার্গেট করসোস এইডা ক! আজকা কারণ না কইয়্যা তুই যাইতে পারবিনা। ”
মুহূর্তের মধ্যেই শিখা কাকির চোখ টলমল করে উঠলো। তবুও নিজেকে শামলে নিয়ে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করলেন। কিন্তু লাভ হলোনা, ছুটতে পারলেন না তাসলি কাকির থেকে। ওনার হাত ছিল মুক্ত অবস্থায়। একে অপরকে ঠেলতে ঠেলতে আমাদের রান্নাঘরের কাছছায় এসে পড়েছিলো ওনারা। পাশের রাখা ছিল শক্ত-পোক্ত বাশের চুঙ্গি। যেটা শিখা খালা নিজের আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করলেন। এক হাতে ওটা উঠিয়ে তাসলি কাকির মোটাসোটা পেটে মেরে বসলেন। মারার সাথে সাথেই ওনি নিজের পেটে হাত দিতে গিয়ে শিখা কে ছেড়ে দিয়ে মাটিয়ে পড়তে লাগলেন। তখনই ওনার স্বামী বাদল কাক ধরে নিলেন। আমার মা-চাচিরা এসে শিখা কাকিকে আটকে নিতে আসলেন। তখনই সবাইকে থামিয়ে দিয়ে ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে শিখা কাকি বলে উঠলেন,
“কেউ আমার ধারে কাছে আসবেন না। আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য শুধুমাত্র এই মহিলা কে আঘাত করেছি।”
“এই শালী! তুই আমার বউয়ের পেটে কেন দিছত? তুই জানোস না ওয় পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।”
তাসলি কাকির স্বামী অর্থাৎ বাদল কাকার এমন কথায় আশেপাশের কয়েকটা পুরুষ আর মহিলা লোক তাল মেলালেন। ‘হ শিখা, কামডা তুমি ভালা করছো না।’
সবার এমন ভাব দেখে শিখা কাকি মুখের দলা থুথুটা প্রথমে মাটিতে আর তারপর বাদল কাকার মুখে মারলেন। এদিকে তাসলি এতক্ষণ ব্যাথ্যায় গড়াগড়ি করলেও থুথু মারার পর থেমে যায়। মূলত শিখা তাকে কম জোর দিয়েই মেরেছিল, কিন্তু গ্রামবাসীদের নিকট প্রমাণের জন্য ব্যাথার নাটক করছিল। কিন্তু মেয়েটার থুথু ফেলায় অবাক হয়ে নিজেকে থামিয়ে নেয় তাসলি। শহুরে মেয়েগুলোর এই সাহস ও থাকে? না! সে তো জানতো এমন বুকের পাটা কেবল এই গ্রামে তারই আছে। কিন্তু...
তখনই শিখার জ্বালাময়ী কথা কানে এলো,
“প্রথম থুথুটা উপস্থিত সবাইকে দিলাম। এই যে! এই মহিলা তাসলি। আমাকে যে এতক্ষণ ধরে আমার শরীরে মারছিল, চুলের মুঠি ধরে ওদিকে থেকে টানতে টানতে এদিকটায় আনলো কই আপনাদের থেকে একটা মানুষ ও তো এগিয়ে আসেন নি! আর যেই আমি আমার আত্মরক্ষার জন্য ওনাকে মারলাম ওমনি আপনারা আমাকে জোঁকের মতো ধরতে আসলেন?”
“এই মাইয়্যা। তুমি এল্লায়গা ওর পেডে মারবা? ওর বাচ্চাডার যদি কিছু হইয়্যা যায়?”
“ওরেহ বাবা! ওনার বাচ্চা পেটে কিন্তু কই ওনার স্বভাবে তো তার ছি'ড়ি দেখতে পেলাম না? ওনি তো দিব্যি এই মোটাসোটা পেট নিয়ে যেভবে পারছিলেন আমাকে মারছিলেন। আর পেটে না দিয়ে আর কোথায় দেব? কোথায় দিলে ওনি থামতেন? আর সরি টু সে ওনি তো আর পুরুষ না যে অণ্ডকোষ বরাবর মেরে দেবো। তাইনা?”
“আহা, মাইয়্যা কয় কি। ছিঃছিঃ। আসলেই শহুরে মাইয়্যার কোনো লাজ নাই। ছেহ! ”
তখনই বাদল উঠে আসতে নিচ্ছিলো। যা দেখে শিখা কাকি বলে,
“কুত্তার/বাচ্চা! আর এদিকে আসবি না। এখন যা বলার, যা করার তা কেবল আমিই করবো!”
শিখা কাকির এতো বড় ধমকে বাদল কাকা থেমে যান। শিখা কাকি আবারো বলতে শুরু করেন,
“ আচ্ছা, আমার প্রতি আপনাদের এতো ক্রোধ আর আক্রোশ কেন? বলতে পারেন? কেবল মাস্টার্স পড়ুয়া মেয়ে বলে? অধিক পড়ালেখা শহুরে মেয়ে বলে?”
উত্তর দেয়না কেউ! ইতোমধ্যে অনেকেই যেতে শুরু করেছে। যা নজর এড়ায় নি শিখা কাকির।
“ সেই তো! যখন আমার দিকে আঙুল তুলবে তখন দাঁড়িয়ে কেবল তামাশা দেখবেন। তাকে নডি/ বে/শ্যা বলে আখ্যা যে দেবে? সেটা উপভোগ করবেন। কিন্তু যখন সেই ন/ডি আর বে/শ্যা মুখ খুলে সত্যর জানান দেবার জন্য তখনই তাকে আপনারা এড়িয়ে চলেন। কেন বলতে পারবেন? ধর্ষ/ণ হলেই কেন নারীর দোষ হবে? কেন নারী লুকিয়ে থেকে চোখের পানি ফেলবে। অধিকার কি পুরুষেরা নিয়ে বসেছে? এই যে আপনারা আমাকে এতোক্ষণ খারাপ মহিলার আখ্যা দিলেন! আমি তো এই গ্রামে আজ না সেই ষোলো বছর ধরে থাকি, কখনো দেখেছেন উলটা পালটা কিছু করতে? কোনো ব্যাট্যাছেলেকে চোখ টিপ দিতে? অসৎ কথা বার্তা বলাতে? না! কেউ দেখেন নি। অথচ আমি এই গ্রামে থেকেই আমার লেখাপড়ার সমাপ্তি টেনেছি। কই কোনো ছেলে বন্ধুকে তো বাসায় আনিনি। তবে আজ কেন অভিযোগ আমার উপর দিচ্ছেন? ”
“এই পঁচা মাইয়্যা। চুপ থাহো! লাজ শরম নাইগা এমনে কথা কও। থামো! বাড়িতে আরো পোলাপান আছে, ওগোলার মাথায় তো গু-গোবর ঢুকাইতাসোও।”
মুখ থেকে পানের পিক ফেলে দাদি এই কথাটা বললেন। শিখা কাকি তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন।
“কি আজব! আপনিও কিন্তু মহিলা। আজ যদি এটা আপনার সাথে হতো? হ্যাঁ হয়তো আমার মতোন এইভাবে কথা বলতেন না সেরকম সাহস আপনাদের নেই কিন্তু লুকিয়ে ছুড়িয়ে এই ব্যাথ্যা আর যন্ত্রণা তো বইতেন। তাই নয় কি? এই যে বাদল! ও আমার ধর্ষ/ক। জোর করে আমায় ধর্ষ/ণ করেছে। আমার স্বামী দুদিনের জন্য গিয়েছিলেন শহরে। আর সেই সুযোগটা নিতেই জানো/য়ার টা এসেছিল আমার বাড়ি। পানি খাওয়ার অযুহাতে আমাকে ঘরে পাঠায় আর নিজেও ঘরে ঢুকে পড়ে। আমি অনেক চেঁচিয়েছিলাম কিন্তু কেউ আমাকে সাহায্য করতে আসেনি। আমার সামনে ভিটের রোজিনা আপাকে জিজ্ঞাসা করেন? সে আমার চিৎকারের আওয়াজ শুনেছিল। ”
কথা শেষ করেই শিখা কাকি এগিয়ে গেলেন তার বয়সের থেকে একটু ছোট একটা মহিলার দিকে। বোধহয় ওনিই রোজিনা।
“আপা? সেদিন না আমায় বাঁচাতে পারোনি। আজ বাঁচাতে হবেনা শুধু জবান টুকুনিও দাও?”
তখন বাদল লোকটা এগিয়ে আসে। ততক্ষণে তাসলি কাকি উঠে দাড়িয়েছে।
“এই এই! ও কি বলবে রে? তুই এই যে এতোক্ষণ বড় বড় কথা কইলি কি ভাবছোস? ওরা তোরে বিশ্বাস কইর্যা নিবো? শোন! নিজের ইজ্জত ফুরাইছোস এহন যাইয়া ঘরের কোণে কান! পুস্তকের জ্ঞান নিতে আইসে না কেউ! যা!”
বলেই একটা ধাক্কা মেরে দেয় শিখা কাকির কাঁধে। পুরুষালি ধাক্কায় কাকি কয়েক হাত দূরে চলে যান। কিন্তু পাত্তা দিলেন না বাদল লোকটার কথা। এগিয়ে আসে আবার রোজিনার কাছে। গা ঝাকিয়ে ফের একই কথা বলে। রোজিনা চোখ তুলে চায়। বড় একটা ঢোক গিলে আস্তে করে শিখা কাকির হাত থেকে নিজের হাত টা ছাড়িয়ে নেয়।
“মধ্যিখানে আমারে ফাসাইতেছোও কেন আপা? আমি তো কিছু শুনিই নাই! তোমারে তো আপা ডাকি, তাই বইলা এই মূল্য দেছাও?”
শিখা কাকি দু'পা পিছিয়ে যান। এ কি শুনছেন তিনি! তার চোখে যেন অবিশ্বাস্যের জটলা মেঘ ধরা দিল। ফের এগিয়ে এসে রোজিনার গা ঝাঁকান।
“রোজিনা! মিথ্যে বলতাছো কেন? কে তোমারে মিথ্যা কইতে কইছে। কও আমারে? তোমার একটা জবান সব বিশ্বাস করাইবো। কও? তুমি চাওনা এই ধর্ষকের শাস্তি হোক?”
রোজিনা মহিলাটা ফের একই কাজ করলেন। হাত টা ঝাড়া মেড়ে দূরত্ব বাড়ালেন। শিখা কাকি বোধহয় বুঝতে পারছেন, হুট করে কাছের কেউ বদলে গেলে ঠিক কতটা কষ্ট হয়!
এইসব কথাবার্তা শুনে এক এক করে সবাই শিখা কাকি কে যা নয় তাই বলে চলে গেল। একজন তো ওনাকে পাগল আখ্যা দিয়ে তবেই খ্যান্ত হলেন! তবে যাওয়ার আগে তাসলি কাকি বাদল কাকার হাত ধরে এগিয়ে এসে তাকে হাটুর পেছনে লা/থি মেরে চলে যান। শিখা কাকি ওভাবেই পড়ে রইলো মাটিতে। তার চোখ দুটো থেকে অশ্রুর বৃষ্টি হচ্ছে, যা মাটি শুষে নিচ্ছে পরম ইচ্ছেয়। শিখা কাকি সেদিকে চেয়ে আছেন। বোধহয় তিনি ভাবছেন তার বয়ে আসা দুঃখ টাকেও যদি এই মাটিটা শুষে নিতে পারতো?
এক পর্যায়ে পরিবেশ টা শান্ত হলো। আমার মা কেবল ওনার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কল পাড়ে রাখা ধোয়া থালা-বাসন গুলো উঠিয়ে এক এক করে রান্নাঘরের চালে রাখতে থাকলেন। রোদের তাপে পানিটা শুকিয়ে যাবে বলে। আমরাও তখন আড়াল থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। শিখা কাকির দিকে একপল তাকিয়ে পেতে রাখা মোড়াটায় বসলাম। কাকি'মা রা ইতামধ্যে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। জুঁই কাকি বড় করে হাঁক ছাড়লেন,
“খবরদার! এখানকার কথা বাপ-চাচাদের কানে নিবিনা আর না তো বলে কয়ে বেড়াবি। এখানে কিছুই হয়নি।”
কাকির কথায় প্রতিবাদী আমিটা জেগে উঠলো। গলা উঁচিয়ে বললাম,
“তবে…”
“ শোনো উষাসী! দস্যিপনা বন্ধ করে পিঠেয় মনযোগ দাও! দুদিন পর ভাই আসলো বলে! আর কি লজিক ফলিক না বলো? ধরে নাও এইটা দুঃস্বপ্ন! উম...! ঘটনা তো হলো এক ঘন্টা। তো মস্তিষ্ক থেকে এই এক ঘন্টা মুছে ফেলো। ”
মায়ের কথায় চুপ মেরে গেলাম। এই একটা মানুষ যাকে আমি জম্মের ভয় পাই! হঠাৎই খেয়াল হলো শিখা কাকি বাড়ির বাইরের দিকে ছুট লাগালেন। মা-কাকি রা'ও সেটা লক্ষ্য করলেন। আর আমি চিন্তিত হয়ে উঠলাম মুহূর্তেই! বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। উদ্বিগ্ন হয়ে মাকে শোধালাম,
“কাকি ওভাবে ছুট লাগালেন কেন? ”
“গেছে যাক! নিজের কাজ করো। অন্যের কিছুতে মনযোগ দিবে না একদম!”
কেন জানি মায়ের কথা শুনতে ইচ্ছে হলো না। ধুকপুক ধুকপুক করা উদর নিয়েই আমিও ছুট লাগালাম শিখা কাকির পথ অনুসরণ করে।
#সুখপাখি_তার_সন্ধ্যাতারা— ১
লেখনিতে— #রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
চলবে...