আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে ১২ ঘণ্টা: বেকারি শ্রমিকদের দিন রাতের লড়াই
মধ্যবিত্তদের সকালের প্রাতরাশ থেকে শুরু করে, শ্রমিক, কৃষক, গৃহপরিচারিকা, হকার, দোকানদারদের ভোরের চা-জলখাবার এবং প্রতিদিনের অফিস যাত্রীদের টিফিনে খাবারের যোগান দিচ্ছে বেকারির শ্রমিকরা।
আমাদের মধ্যে অনেকেরই বেকারির খাবার খুবই পছন্দের। পাউরুটি-কলা, গুঘনি পাউরুটি, স্লাইস পাউরুটির বাটার টোস্ট, কোয়াটার পাউরুটির ডিম বা বাটার টোস্ট, কিসমিস দেওয়া বেকারির কেক, লেড়ো,লাঠি ইত্যাদি হরেকরকমের খাবার। জিভের স্বাদ,পেটের খিদে মেটাতে বেকারির বিকল্প নেই। রেলস্টেশনে, বাজারে পথচলতি অজস্র মানুষের খিদে মেটাচ্ছে শহর,মফস্বল, গ্রামের ছোট ছোট বেকারি কারখানাগুলি। এই কারখানাগুলিতে সরারাত জেগে শ্রমিকরা গোল পাউরুটি, কোয়াটার পাউরুটি, লম্বা পাউরুটি, স্লাইস পাউরুটি, বেকারির কেক, বিস্কুট, নানা ধরনের টোস্ট,প্যাটিস ইত্যাদি তৈরী করেন।
দেশের কথা পত্রিকা- পাউরুটি, কেক ইত্যাদি তৈরির শ্রমদাতা শ্রমিকদের আগুনে ঝলসানো শ্রমকে বুঝতে কারখানাগুলিতে সমীক্ষা করেছে। সমীক্ষায় উৎপাদন, বেকারি শিল্প সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য আমরা জানতে পারলাম। শ্রমিকরা বোঝালেন উৎপাদন কিভাবে হয়, পরিচালনা কিভাবে হয়, মালিকদের নানারকমের শোষণের ফাঁদ।
এই ছোট ছোট বেকারিগুলিতে শ্রমিকের সংখ্যা খুবই কম। গড়পড়তায় ৭-৯ জন করে কাজ করেন। দিনের কাজ ও রাতের কাজ মিলে প্রতি বেকারিতে শ্রমিক সংখ্যা ১৪- ১৮ জন। রাতের কাজ- নানা ধরনের পাউরুটি, কেক তৈরী করা। দিনে বিস্কুট,লেড়ো, প্যাটিস ইত্যাদি তৈরী করা হয়।
বেকারিগুলিতে ঘণ্টা সিস্টেমে মজুরি ব্যবস্থা চালু নেই। মাথা পিছু ময়দার ওজনের ভিত্তিতে মজুরি ব্যবস্থা চালু আছে। পাউরুটির ক্ষেত্রে প্রতি মাথা পিছু ৪০ কেজি ময়দার কাজ, প্রতি মাথা পিছু ২২ কেজি কেক, বিস্কুট ও লেড়োর ক্ষেত্রেও ২২ কেজির চুক্তি থাকে। মাথা পিছু এর বেশি ওজন বাড়লে ওভার টাইম হিসাবে ধরা হয়।
বেকারিগুলিতে ওভারটাইম শ্রমিকেদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। কাজের শুরুতেই বেকারি মালিকের কাজের অর্ডার অনুযায়ী তিন চার 'মাথা' কাজ প্রতিদিন ওভারটাইম হিসাবে করতে হয়, কারন কাজের শুরুতেই অর্ডারের ভিত্তিতে ময়দা মাখা হয়। আর একবার ময়দা মাখা হয়ে গেলে তা পাউরুটি, কেক, বিস্কুট ইত্যাদিতে রূপান্তরিত করার পরেই একমাত্র শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে পারেন। মালিকরা উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা, শ্রমিকের স্বল্পতা ও কম মজুরির সুযোগ নিয়ে ওভারটাইম বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। অর্ডার অনুযায়ী মালিক মাল তৈরী করাতে না পারলে বেকারি পণ্যের মার্কেট হাতছাড়া হয়ে যায়, তাই বেকারি মালিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা যায়।
রাতের কাজের শ্রমিকরা( যারা মূলত পাউরুটি তৈরী করেন) সন্ধ্যা ৭ টা থেকে পরের দিন সকাল ৮ টা পর্যন্ত কাজ করেন, অনেক সময় ওভারটাইমের 'মাথা' বেশি থাকলে কাজ ছাড়তে ৯ টাও বেজে যায়। দিনের ও রাতের শ্রমিকদের রোটেশন করে উৎপাদন পরিচালনার ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকরা বছরের পর বছর রাত জেগে কাজ করেন। শ্রমিকরা ৪০ কেজি পাউরুটির 'মাথাতে' মজুরি পান ৩৭৯ টাকা, এবং ৬ টাকা টিফিন বাবদ পান। আর চার বা পাঁচ মাথা ওভার টাইম হলে সেই টাকা শ্রমিকদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
কারখানায় মূলত চারধরনের দক্ষতার শ্রমিক থাকে। বাচ্চা, সেয়ানা, মাথা লোক, মাথা মিস্ত্রি। বাচ্চা অর্থাৎ শিক্ষানবিশ,যাদের শুরুতে কাজ হল পাতা মোছা ( ট্রে,ফ্রেম মোছা), এই শিক্ষানবিশদের মজুরি ২০০ টাকা। এই ছোট ছোট বেকারিগুলিতে ৮-৯ শ্রমিক নিয়ে উৎপাদন চালানো হয় বলে প্রতি ধাপের কাজে আলাদা করে বিভাগ তৈরী করা হয় না। প্রতিটি শ্রমিককেই প্রতিটি ধাপের কাজ শিখতে হয়।
'সেয়ানা' যারা পুরো 'মাথার' ওজন ও ওভারটাইমের ওজনের কাজ করতে পারেন না কিন্তু কাজ শিখে গিয়েছে তারা হল সেয়ানা, এই শ্রমিকদের মজুরি ২৫০-৩০০ টাকার মধ্যে থাকে। মাথা লোক অর্থাৎ যারা পুরো কাজ জানেন, বেকারির সবধরনের খাবার তৈরী করতে পারেন, ওভারটাইমও করেন, তাদের মাথা হিসাবে ধরা হয়। এদের মধ্যে একজন মাথাকে মিস্ত্রি করা হয়, এই মিস্ত্রি শ্রমিকরা নিজের কাজ করেও কারখানায় উৎপাদন পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এদের মজুরি সাধারণের থেকে ১০-১৫ টাকা বেশী।
বেকারিতে দৈনিক মজুরি ব্যবস্থা চালু আছে, যদিও অনেক বেকারি মালিক মাঝে মাঝে শ্রমিকদের মজুরি আটকে রাখে। শ্রমিকদের পিএফ, পেনশান ইত্যাদির ব্যবস্থা নেই। কিছু বেকারিতে শ্রমিক আন্দোলননের ফলে সাপ্তাহিক সবেতন ছুটি দিতে মালিকরা বাধ্য হয়। শ্রমিকদের ধারাবাহিক ধর্মঘট,আন্দোলনের ফলে মজুরি বৃদ্ধি হয়। কিন্তু শ্রমিক স্বল্পতা, শিল্প সংকট শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে।
দশকের পর দশক কাজ করার পরও শ্রমিকদের এত অল্প মজুরি,অথচ পুরানো যুগের ভাটার আগুনের তাপ, খামি( ময়দা মাখানো,যা আগে হাত দিয়ে করা হত) মাখা, ১২ ঘন্টা একটানা দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করা ইত্যাদি প্রতিটি ধাপের কাজে হাড়হিম করা পরিশ্রম থাকে, ফলে কয়েকদশক ধরে চলছে বেকারিতে শ্রমিক স্বল্পতা, নতুন শিক্ষানবিশ কাজে ঢুকছে না, ঢুকলেও কাজের চাপে, পরিশ্রমে, ২০০ টাকা মজুিরর বিনিময়ে বছরের পর বছর কাজ শেখা, 'সেয়ানা' হয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা ইত্যাদি কারনে শিক্ষানবিশরা কাজ শিখতে শিখতে বেকারি ছেড়ে চলে যায়। দীর্ঘদিনের শ্রমিকরাও শিল্পের দৈন্যদশা, অল্প মজুরির জন্য নিজের ছেলে মেয়ে, আত্মীয় দের কাজে নিয়ে আসে না। এমনকি বহু বেকারি শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে বা চেষ্টা করছে।
মালিকদের পুঁজি থাকলেও তারা মজুরি বাড়ায় না, বেকারি শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করে না। মুনাফা লোভী মালিকদের জন্য আজ বেকারি শিল্পে শ্রমিক স্বল্পতা দেখা গিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই খারাপ শ্রমিক স্বল্পতার কারনে একের পর এক বেকারি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে চলতি বেকারিও এক দুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। উৎপাদনে বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। মালিকরা একে ওপরের কারখানার শ্রমিকদের ভাঙিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছু অতি সেয়ানা মালিক তো ২২ কেজি মাথার( কেক, বিস্কুট ক্ষেত্রে) হিসাব বাড়িয়ে ৩৬ কেজি করে দিয়ে শ্রমিকদের মজুরি ১০০ টাকা বাড়িয়ে, দীর্ঘদিনের শ্রমিকদের ধরে রাখার এবং অতিরিক্ত শোষণের ফন্দি চালু করেছে, কিছু মালিক শ্রমিকদের সুখ দুঃখে টাকা ধার দিয়ে শ্রমিক ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
অথচ মালিকরা মজুরি না বাড়ানো ক্ষেত্রে দলবদ্ধ।
বেকারি ব্যাবসা নগদ টাকার ব্যবসা। সারা রাতে নগদ টাকা বেড়ে যায়। মালিকরা রাতে ময়দা দেখে ঘুমাচ্ছে, সকালে তা পাউরুটি হয়ে যাচ্ছে, সকালবেলায় লাইনম্যানদের( বেকারির হকারদের) কাছে বিক্রি করেই হাতে নগদ পয়সা এসে যাচ্ছে। মালিকরা নগদ টাকার গন্ধে এতটাই মসগুল যে তারা কারাখানাগুলিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সেই নগদ থেকে মজুরি বাড়াতে মালিকদের বুক কেঁপে ওঠে। শ্রমিকদের অভিযোগ মালিকদের লোভই বেকারি শিল্পকে শেষ করে দিচ্ছে।