মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী (রহ:)
(সুফি, কামেল, কবি, সাহিত্যিক, ভাষাবিদ, রাজনীতিবিদ, প্রতিবাদী নেতা, সমাজ সেবক, সমাজ সংস্কারক।
তাঁকে নিয়ে লেখার বিন্দুমাত্র জ্ঞান, যোগ্যতা, সাহস কোনোটাই আমার নেই। মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী (র.) ইংরেজি ১৮৯৭ সাল, বাংলা ১৩০৩ সালের ফাল্গুন মাসে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার লংগাইয়ের মাইজবাড়ি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
পিতা মৌলভী ক্বারী মোঃ রিয়াজ উদ্দিন,পীরে কামেল ও মোকাম্মেল হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন, তিনি ছিলেন ভারতের বিখ্যাত আলেম রশীদ আহমদ গঙ্গুহী(র.)'র খলিফা। তাঁর কেরামতি আজও গফরগাঁওয়ে মানুষের কাছে রুপকথার মত কাহিনী হয়ে আছে। একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল-তাঁর ঘোড়া সুদখোর ও বেনামাজির দানা খাইত না।
অন্যদিকে মাতা মোছাঃ উম্মে কুলসুম ছিলেন ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্না আল্লাহ্ওয়ালী।
মৌলভী মোঃ রিয়াজ উদ্দিন সাহেব ইংরেজ জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। নিজেকে জড়িয়ে ছিলেন ৩/৪ টি মামলায়। পাঁচভাগী সাহেবের জন্মের কয়েক বৎসর পর মৌলবি রিয়াজ উদ্দিন সাহেব মাইজবাড়ির সমস্ত সম্পত্তি নিজেগড়া মাদ্রাসা, মসজিদে ওয়াকফ দিয়ে পাঁঁচবাগে চলে আসেন। উল্লেখ্য যে গ্রামটিতে পাঁচটি জমিদারের অংশ বা হিস্যা বিদ্যমান ছিল।সে কারণেই গ্রামটির নাম হয়েছিল পাঁচবাগ।(পাঁচভাগ নয়)।
মাওলানা শামছুল হুদা(র.) শিশুকাল থেকেই ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ও মেধাবী। তাঁর নামের অর্থ হেদায়তের সূর্য।সূর্যের মত তিনিও আলোকিত করেছিলেন ভারত উপমাহাদেশের সমস্ত মানুষকে।তাঁর জ্ঞানের আলোতে অগণিত মানুষ হেদায়েত প্রাপ্ত হয়ে সঠিক পথের দিশা পেয়েছিলেন। তাঁর নিকট হতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সকল মানুষ সম্ভাবে উপকৃত হতেন।
মাত্র ১২ বছর বয়সে ফাজেল পরিক্ষায় মাদ্রাসা বোর্ডে সমস্ত ভারত উপমহাদেশে প্রথম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তবে ইংরেজ মহিলার হাত থেকে স্বর্ণপদক গ্রহণ করতে হবে জানতে পেরে অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন এবং স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন নাই।
এরপর ভারতের রামপুর স্টেট মাদ্রাসায় ভর্তি হতে গেলে শিক্ষকরা তার সম্পর্কে জেনে বলেন তোমার এখানে ভর্তি হয়ে কোনো লাভ হবে না, তুমি শিক্ষকদের চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখো।
তারপর বিখ্যাত আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হযরত মাওলানা আব্দুল আজীজ সাহানাপুরী সাহেবের সান্নিধ্যে ৩০ বৎসরের পাঠ্য মাত্র ৩০ দিনে সম্পন্ন করেন। দার্শনিকও হয়েছিলেন আশ্চর্যান্বিত। জানা যায় দার্শনিক সপ্তাহে মাত্র এক দিন মাদ্রাসার শিক্ষকমণ্ডলী ও যোগ্য ছাত্রদের একত্রে একটি ক্লাস নিতেন। বিভিন্ন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এবং নাম করা শিক্ষকগণ দর্শন শাস্ত্রে জ্ঞান লাভের আশায় এখানে যেত।
বালক শামছুল হুদা(র.)কে দেখে দার্শনিক বলেছিলেন তুমি অনেক ছোট লেখাপড়া শেষ করে পরে আমার কাছে এসো। শামছুল হুদা(র.)সুযোগ প্রার্থনা করলেন। দার্শনিক বিরক্ত হয়ে দর্শন শাস্ত্রের একটি বই হাতে দিয়ে বললেন এটা পড়শেষ করে আরো কিছুকাল পরে এসো।
মাওলানা সাহেব বইটি হাতে নিয়ে বাসায় চলে আসলেন। আশ্চর্যজনক ব্যাপার মাওলানা সাহেব হাতে বই নিয়ে পরদিন দার্শনিকের সামনে হাজির। দার্শনিক তাঁকে দেখে বিরক্ত সহকারে বললেন- আমি আগেই বলেছিলাম তুমি ছেলে মানুষ এগুলো বুঝার বয়স তোমার হয়নি। শামসুল হুদা (র.) বললেন হুজুর আমি পড়ে শেষ করে জেনে বুঝেই এসেছি।
দার্শনিক রাগান্বিত হয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, মাওলানা সাহেব অত্যন্ত চমৎকার ভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দার্শনিক কে অবাক করে দেন। দার্শনিক আবার তাঁর হাতে আরেকটি বই দিয়ে পড়ে শেষ করে আসতে বললেন।
মাওলানা সাহেব পরের দিনি আবার এসে হাজির। দার্শনিক সাহেব প্রশ্ন করার আর সাহস পাননি, মাওলানা সাহেবের জ্ঞানের গভীরতায় শ্রদ্ধায় উনার মাথা নত হয়ে আসে। দার্শনিক আবার আরেকটি বই দেন এভাবে ২৯ তম দিনে একটি বই দিয়ে বললেন এই বইটা খুব ভালো ভাবে পড়বে ইহা আধুনিক বিজ্ঞানের আপেক্ষিক গুরুত্ব, বইটা খুব কঠিন।তাই মনযোগ দিয়ে ভালোভাবে পড়ে আসবে।
মাওলানা সাহেব এই বইটি নিয়েও পর দিন হাজির। দার্শনিক হতভম্ব এতো কঠিন একটি বই কিভাবে একদিনে পড়ে শেষ করা সম্ভব!
দার্শনিক কয়েকটি কয়েকটি কঠিন প্রশ্ন করে যথাযথা উত্তর পেয়ে বলেন-''যু ইলম খোদা কিছিকো তিরিশ বরছ মে দিতা; আওর কিছিকো তিরিশ দিন মে দিয়া"।
কিছুদিন পর দার্শনিক শামছুল হুদা(র.)কে ডেকে বলেন, 'তুমি দেশে চলিয়া যাও, এখানকার বিদ্যা তোমার শেষ হইয়া গিয়াছে।দেশে গিয়া মানুষের সেবা কর।'
অতঃপর একরাত্রে স্বপ্নে রামপুর স্টেটের শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক আলেম ও বুজুর্গানে দ্বীন হযরত মাওলানা শাহ্ মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ(গুজরাটি)সাহেবের সাথে সাক্ষাতের নির্দেশ প্রাপ্ত হইলেন।
আধ্যাত্মিক বিষয়ে গভীর আলোচনার পর মাওলানা সাহেব পাকিস্তানের লাহোরে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য 'মুন্সী ফাযিল ডিগ্রী'(ইংরেজি শিক্ষা বিষয়ক তখনকার ডিগ্রীর নাম)অর্জন করতে অরিয়েন্টাল কলেজে যান।
সেখানেও একি ঘটনা ঘটে। কিছুদিন পর বাবার পত্র পেয়ে দেশে ফিরে আসলে কিছুদিনের মধ্যেই পিতার ইচ্ছায় তাঁকে নান্দাইলের পাঁচরুখী গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সাঈদা নাম্নী নামে সুদর্শনা ও সর্বগুণে গুণাণ্বিতা এক কন্যার সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইতে হয়। যদিও পরিবার সংসারে তার ধ্যান ছিলনা।তখন ছিল ইংরেজ আমল, জমিদাররা ছিল ইংরেজদের খুব বিশ্বস্ত, খাস লোক। জমিদাররা জমির ফসল,খাজনা আদায় করে ইংরেজদের হাতে উঠিয়ে দিত। জমিদাররা প্রায় সবাই ছিল হিন্দু। তারা মুসলমানদের উপর নানা প্রকার নির্যাতন করত।গরু জবাই করতে দিত না, জুতা পায়ে কিংবা ছাতা মাথায় তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দিত না। মুসলমানরা মুখে দাড়ি রাখলেও ট্যাক্স দিতে হত। মুসলমানদের সব কিছুকেই করা হত অপমান অপদস্থ। মসজিদের সামনে ঢোল- ঢাগ পিঠিয়ে গানবাজনায় মেতে উঠত। মাওলানা সাহেব জমিদারদের বিরুদ্ধে মনে মনে জ্বলে উঠতে লাগলেন।
গরু জবাই করার অপরাধে বাঘেরগাঁওয়ের সাহেব আলী মুন্সী ও ছিপান গ্রামের জনৈক এক ব্যক্তিকে জমিদাররা যথাক্রমে ৫০০ টাকা ও ৫০ টি বেত, ৭০০ টাকা ও ২০ টি বেত ধার্য করে।
এদের একজনকে ৭০০ টাকা দিতে গিয়ে নিজের বাড়ি ভিটা টুকু বিক্রি করতে হয়েছিল।ব্রিটিশ আমলে ৭০০ টাকা মানে অনেক কিছু!
মাওলানা সাহেব এগুলো সহ্য করতে পারলেন না, প্রতিবাদ ও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন এর ফলেই ৫৫০ টিরও বেশি মামলার আসামী হতে হয়েছিল তাঁকে। জমিদাররা মাওলানা সাহেবকে হত্যারও চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়।
মাওলানা সাহেবের বিরুদ্ধে প্রায় ৭৫০ জন ছোট বড় জমিদার মিলে গঠন করে ল্যান্ড লর্ড এসোসিয়েশন এবং মাওলানা সাহেব জমিদার হওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়।মাওলানা সাহেব বলেন আমি জমিদারি পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয় বরং তা উচ্ছেদের উদ্দেশ্যেই আমার লড়াই।
অতপর জমিদাররা মিলে যে মামলা করেছিল তা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধারা বর্ণনার মামলা, সেই সময়ে মামলাটি তৈরি করতে ১২০০ টাকার কাটির্স কাগজই লেগেছিল।
১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের জাঁদরেল নেতা মৌ. তমিজ উদ্দীনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে পাক ভারত উপমহাদেশের সর্বপ্রথম আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩৭ সালে দিল্লির সংসদ সদস্য (এম.এল.এ.) নির্বাচিত হন।তৎকালীনন চলমান রাজনীতির সাথে নিজের মত ও পথের পার্থক্য দেখে ১৯৩৮ সনে 'ইমারত পার্টি' গঠন করেন। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর সা.সম্পাদক ছিলেন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মৌলভী আব্দুল ওহাব।
সে সময় মুসলমানরা মাছ বিক্রি,চুল কাটা একাজ গুলো করতো না। গরিব মানুষের না খেয়ে থাকার চেয়ে চুল কাটা, জুতা পালিশের কাজ কারও উত্তম। মাওলানা সাহেব নিজে বাজারে কাঁচি চিরণী নিয়ে নিজে চুল কাটতেন, মাছের ডালা নিয়ে বসে যেতেন, মাঝি ও মুচির কাজও নিজ হাতে করে মানুষকে উৎসাহিত করেন।এরপর থেকে মানুষ একাজ গুলোকে আর ঘৃণার চোখে নেয়নি।মাওলানা সাহেব ধর্মের কুসংস্কার থেকে বেড়িয়ে আসতে হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছেন।মাওলানা সাহেব ছিলেন ছিলেন খুব সাদাসিধে লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরেই তিনি দিল্লির সংসদে যেতেন।একবার আলোচনা হয় এমন জায়গায় কেউ লুঙ্গি পরে আসে? মাওলানা সাহেব বলেন, 'যাদের ভোটে আমি সংসদ সদস্য হয়েছি সে মানুষ গুলোর গায়ে ছেড়া লুঙ্গি গেঞ্জি ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনা'
তিনি ছিলেন জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের মহানায়ক, কলকাতার সাথে আরও অনেক গুলো এলাকা নিয়ে তিনি স্বাধীন বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতেন এবং আন্দোলন করেছেন।কিন্তু ইতিহাসে আজও উনার নাম উঠে নাই,নাম উঠেছে যারা পাকিস্তান সৃষ্টির লক্ষে ব্যস্ত ও মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
মাওলানা সাহেবের বাড়িতে ছাপাখানা ছিল।বাংলা, উর্দু, আরবী ও ইংরেজি পত্রিকা এবং প্রতিবাদী বিজ্ঞাপন এখান থেকেই ছাপাতেন। উনার পার্টির হেড অফিস পাঁচবাগেই ছিল।
১৯৪৬ সালে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে বাংলার প্রায় সকল শ্রেণির মানুষ যুক্ত হয়েছে ঠিক তখন তিনি নিজস্ব একটা পার্টি গঠন করেন যার উদ্দেশ্য ছিল এপারওপার বাংলাসহ যুক্ত ও মুক্ত বাংলার জন্য আন্দোলন ও প্রতিবাদী ভাষায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কুফল তোলে ধরা।
তাঁর সৃষ্ট স্লোগান ছিল- 'পাকিস্তান হায় ফাকিস্তান/পাকিস্তান হল জালেমের স্থান'
কে বলে মি.জিন্নাহ মোদের দুলাল/সেতো ইংরেজদের দালাল'।
'মিছে কেন পাকিস্তান জিন্দাবাদ /ইংরেজ তাড়াই,পাঞ্জাবী আনতে আনতে যাই'। আরও কিছু সংগঠন ছিল যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল।পশ্চিম ও পূর্ব বঙ্গের কেন্দ্রীয় মুসলিমলীগের বড় বড় নেতারা গফরগাঁও এসেছিল পাঁচভাগীর আন্দোলনকে স্থবির করে দিতে।
পাকিস্তানের লিয়াকত আলী খান, মৌলবি সাব্বির,খাজা নাজিমুদ্দিন আরও অনেকে এদেশের নেতাদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী, ওসমানী এবং তাদের সাথে আরও শত শত সাঙ্গ-ফাঙ্গ।
নিরাপত্তার কথা ভেবে মি.জিন্নাহ আসার সাহস পাননি।
নেতারা ট্রেনে গফরগাঁও এসে ট্রেন থেকে নামার পূর্বেই মাওলানা সাহেবকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ শুরু করলে নিচে থেকে হাজার হাজার পাথর বন্ধুকের গুলীর ন্যায় ট্রেনে নিক্ষিপ্ত হয়, নেতারা বগির ভেতর গা ঢাকা দেয়।
পাকিস্তান পন্থি মুসলীমলীগের নেতাকে হারিয়ে তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। যারা পাকিস্তান নরপশুদের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান করলেন পরিশেষে আমরা কী পেলাম? ৩০ লাখ মানুষের জীবন, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আর কত সহস্র ত্যাগ।
মাওলানা সাহেব চেয়েছিলেন রক্তপাত বিহীন, যুদ্ধ বিহীন বিশাল এক বাংলা বিশ্বের দরবারে আমরা পেতাম বিশাল এক মানচিত্র।
'ইংরেজ তাড়াই পাঞ্জাবী আনতে যাই' এই বাণীটুকুর মাধ্যমেই আমরা ২৪ বছরের পাকিস্তানি শোষণ, ভাষা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে লাখো মানুষের জীবন ত্যাগ, দু'লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হারনোর করুণ কাহিনী লুকানো।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান সরকার মাওলানা সাহেব কে ৮ বছর গৃহবন্দি করে রাখে, তিনি হলেন প্রথম এবং প্রধান রাজবন্দী। তাঁর খাতাপত্র, ৫টি ভাষায় লিখিত অতি মূল্যবান একটি অভিধান পাকিস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
তারপর ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ছালাম, রফিক,বরকত, জব্বার,শফিকের শহীদ অতি ক্ষোভ ও অন্তর ভরা ব্যথার সৃষ্টি করে। তিনি উপলব্ধি করে ভবিষ্যৎ আরও ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে।তিনি নিজের হাতে লেখা বিজ্ঞাপন বিলি করতে থাকেন- 'মোদের কপালে ছাই/ রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই'।
এ জাতির উদ্দেশ্যে বলেন,পাকিস্তান মোহে পড়ি/আজ মোদের গলায় দড়ি', হুজুগে বাঙালি /হেকমতে চীন', বিধির বিধান অনুসারে /অচিরেই দুই বাংলা এক হতে পারে'।
১৯৭১ সালে উনি রাজনৈতিক ভাবে স্থবির বলা চলে, উনার প্রেস বন্ধ, পাকিস্তানি সরকারের শত মামলা তার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে করেছে হ্যাস্ত ন্যাস্ত।
তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান- প্রাইমারি স্কুল,হাই স্কুল,গার্লস স্কুল,ফাজেল মাদ্রাসা,হাফেজি মাদ্রাসা এতিমখানা ও বিশাল মসজিদ।নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও তার অবদান অনস্বীকার্য। ময়মনসিংহ শহরে রিয়াজুল জেনান মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ময়মনসিংহের প্রখ্যাত বালিয়া মাদ্রাসা তাঁর সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল।
তিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে নারীদের কামিল পাস অর্থাৎ এম.এ পাসের সুযোগ করে দেন। তাঁর মেয়ে জনাবা খালেদা খানম উপ-মহাদেশের নারীদের মধ্যে প্রথম কামিল ডিগ্রী গৌরব অর্জন করে।
যুদ্ধের সময় দীর্ঘ ৯ মাস ব্যাপি অসংখ্য হিন্দু পরিবার তাঁর বাড়িতে ছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। তাদের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করেছেন হাজার হাজার পরিবারের। মাওলানা সাহেব পুরো জীবনে ১০২১ টি মামলার আসামী হয়েছেন কিন্তু কোনো মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে জেল খাটাতে পারেনি।
সমাজের সকল ধর্ম বর্ণের প্রতিটি মানুষের অধীকার আদায়ে অতি বলিষ্ট একজন নেতা, নিবেদিত প্রাণ।
মাওলানা সাহেব ছিলেন উচ্চমাপের একজন সুফী কামেল ব্যক্তি। উপমহাদেশের বড় বড় ব্যক্তিরা নির্দ্বিধায় তা স্বীকার করেছেন।
*কথিত আছে তিনি ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় একি সাথে দুই আদালতে স্বশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন।
*পাটশোলার আঁটিতে করে লাটি বৈঠা বিহীন নদীর স্রোতে উল্টো দিকে নদীর পার হয়েছেন।
*উনার নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল ট্রেনের ইঞ্জিন বিকলাঙ্গ হয়ে।
মাওলানা সাহেবের ছাত্র অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আন্ওয়ার উল্লাহ জিজ্ঞেস করেছিলেন হুজুর আপনার কোনো কেরামতি দেখলাম না,উত্তরে বলেছিলেন,"কেন?দেখনা প্রতিদিন শত শত লোকের খাবার ও শত শত মোকাদ্দমার খরচ কিভাবে চলে? আমার কি কোনো আয়ের উৎস আছে?"।
তিনি আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা ছিলেন ইহা সর্বজন স্বীকৃত।তাঁর অলৌকিকতা,কেরামতীর কথা ময়মনসিংহের ঘরে ঘরে এখনো শুনা যায়, বহু জীনও তার মুরিদ ছিল, কারও জীন-পরীর আছর হলে তাঁর বাড়িতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রমাণ পাওয়া যেত। আছরকারী স্বেচ্ছায় ক্ষমা প্রার্থনা করত। বহু পাগল তাঁর দরবারে এসে আরোগ্য লাভ করে সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন যাপন করার প্রমাণ পাওয়া যায়।
তিনি ছিলেন একজন সু-সাহিত্যিক ও ভাষাবিদও।
৫০ বছর পূর্বেই তাঁর আরবী সাহিত্যের বিজ্ঞান বিষয়ক লিখিত একটি বই 'মানতিক' কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসেবে স্থান পেয়েছে।
মাওলানা সাহেব রাজবন্দী থাকা অবস্থায় লিখেন-সংক্ষিপ্ত তাৎপর্যসহ সূরা ইয়াসীনের বঙ্গানুবাদ;কারাজীবনের উপঢৌকন ;আরবী ভাষায় সহস্রাধিক দোআর কিতাব- কিতাবুল আদইয়া।
মাওলানা সাহেবের রচিত একটি কবিতা-
আমি বিদ্রোহী-
সত্যাগ্রহ ধর্ম মোর এ যদি হয় বিদ্রোহ,
নত শিরে শিরোধার্য হেন জলন্ত বিদ্রোহ।
আমি নহি আল্লাহদ্রোহী, নহি কভু সত্যদ্রোহী
দেশদ্রোহী নহি কভু, নহি ধর্মদ্রোহী ব্রুহী।
তবুও আমি বিদ্রোহী- বলে সে কোন বিদ্রোহী?
আমি তবে সে বিদ্রোহী, কুচ পরওয়া নাহি।
ধর্মকে করিতে রক্ষা,আমি করিয়াছি পণ,
করিব সত্যের পূঁজা, এ যে মোর দৃঢ় পণ।
বাধা যতই পাব 'না' আমি নিরাশ হব না,
আমার আছে বিশ্বাস, জয়ী হব একদিন,
সত্য নহে পরাভূত, ইহা সত্য চিরদিন।
মনীষী, সমাজ সংস্কারক, সুফী, কামেল, কবি, সাহিত্যিক, ভাষাবিদ, সমাজ সেবক, রাজনীতিবিদ, সুবক্তা, প্রতিবাদী নেতা মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী (র.) ১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন।
স্থান সংকুলান না হওয়ায় তাঁর জানাজা নামাজ ৮ বার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ৮ম বারের জানাজা নামাযেও মাঠ মানুষে পরিপূর্ণ হয়।
৮ম বার জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পাঁচবাগ মসজিদ সংলগ্ন তাঁর পিতা-মাতার কবরের পাশে তাঁকে চির শয্যায় শায়িত করা হয়।
কপি
পেস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন