এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

এই ব্লগটি সন্ধান করুন

রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ফেইসবুক থেকে নেওয়া

 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তরঅষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার আর্থিক ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৯৭৬ বঙ্গাব্দ, ১৭৭০ খৃষ্টাব্দ)। এর আগের দেড়শো বছরের বাংলার ইতিহাসে অমন ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি। তখন মাঝে মাঝে স্বল্পকালস্থায়ী খাদ্যাভাব দেখা দিলেও, সেগুলিকে কোনোমতেই দুর্ভিক্ষ বলে আখ্যা দেওয়া যায় না। এমনকি উক্ত সময়ের আগে ইংরেজ, ফরাসি বা ওলন্দাজদের পুরানো নথিপত্রেও বঙ্গদেশে ওরকম কোন বড় দুর্ভিক্ষের উল্লেখ পাওয়া যায় না। ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে অনাবৃষ্টি তথা খরা থেকেই সাধারণতঃ বাংলা তথা ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষের সূত্রপাত ঘটেছিল। একই সাথে সেটির আনুষঙ্গিক দিকটি ছিল, ওই সময়ের সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য। অর্থনীতি বলে যে, যদি জনগণের আর্থিক সামর্থ্য থাকে তাহলে অনাবৃষ্টি ও খরাজনিত পরিস্থিতিতে তাঁরা পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বা বিদেশ থেকে আমদানীকরা খাদ্যশস্য কিনে দুর্ভিক্ষের সময়ে নিজেদের জীবন ধারণ করতে পারেন; ওরকম অবস্থায় জীবনহানি কম ঘটে। কিন্তু জনগণের হাতে যদি যথেষ্ট সম্পদ না থাকে তাহলে অনাবৃষ্টি ও খরাজনিত পরিস্থিতিতে তাঁরা খাদ্যশস্য কিনে নিজেদের বাঁচাতে পারেন না, আর সেই অবস্থায় সাধারণ মানুষ দলে দলে মৃত্যুর সম্মুখীন হন। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া, ১ম খণ্ড, রমেশচন্দ্র দত্ত, পৃ- ৫১) ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ে বঙ্গদেশে ঠিক ওরকম পরিস্থিতিই সৃষ্টি হয়েছিল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল অনাবৃষ্টি। ১৭৬৮ সালের আগস্ট মাস থেকে ১৭৬৯সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলা ও বিহারে অস্বাভাবিক অনাবৃষ্টি, খরা ও শস্যহানি সেই কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকা রচনা করেছিল। সমকালীন সাহিত্যেও ওই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় - “নদ নদী খাল বিল সব শুকাইল।


অন্নাভাবে লোকসব যমালয়ে গেল।” (ইতিহাসাশ্রিত বাংলা কবিতা, সুপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়, পৃ- ৮৬)


উক্ত সময়ের বাংলায় দীর্ঘ অনাবৃষ্টির ফলে ১৭৬৮ সালের আউস এবং পরের বছরের আমন ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ১৭৬৯ সালের জানুয়ারী মাসের অল্প কয়েক ঘন্টার বৃষ্টির জল কোনো কাজেই লাগেনি। পরবর্তী ছ'মাসেও বঙ্গদেশে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। এর ফলে চৈত্র-বৈশাখ মাসের সংগ্রহযোগ্য চৈতালি ফসলও নষ্ট হয়েছিল। পর পর তিনটি ফসল নষ্ট হওয়ায় পরিস্থিতি তখন ক্রমশঃ সঙ্কটজনক হতে শুরু করেছিল। এরপরে ১৭৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ফসলও সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। (দি এগ্রেরিয়ান সিস্টেম অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এ. সি. ব্যানার্জী, পৃ- ১২৯) ওই সময়ে বাংলার শস্য ক্ষেত্রগুলি স্রেফ শুকনো খড় বুকে নিয়ে পড়ে ছিল। ওরকম অবিশ্বাস্য অনাবৃষ্টি, খরা ও শস্যহানি স্মরণযোগ্য কালের মধ্যে বঙ্গদেশে ঘটেনি। ওই সময়ের অতিবৃদ্ধরাও ওরকম ভয়ঙ্কর অনাবৃষ্টি ও খরা কখনো দেখেননি বলে সমকালীন সাক্ষ্য থেকে জানতে পারা যায়। সমগ্ৰ ছিয়াত্তর সন ধরে (১৭৭০ সাল) বঙ্গদেশে সেই দুর্ভিক্ষ চলেছিল। সেটি মূলতঃ একবছরের টানা দুর্ভিক্ষ হলেও, ব্যাপকতা ও ভয়ঙ্কর পরিণতিতে তা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব দুর্ভিক্ষকেই ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেই দুর্ভিক্ষ চলাকালীন বঙ্গদেশে বিভিন্ন রোগ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিল। তখন বাংলার সর্বত্রই মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিল। মুর্শিদাবাদ শহরেও ওই সময়ে মারাত্মক গুটি বসন্ত রোগ দেখা দিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে সিয়ার মুতাক্ষরীণ' রচয়িতা ‘গোলাম হোসেন' লিখেছিলেন, “১৭৭০ সালের মহরম মাসে (মে, ১৭৭০) দুর্ভিক্ষ ও গুটি বসন্ত রোগ একসঙ্গে দেখা দিল। তারা ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে পুরো তিন মাস ধরে তাণ্ডব চালালো। এই দুই অভিশাপের কবলে পড়ে বহুলোক প্রাণ হারালো ... বহু গ্রাম ও শহর একেবারে নিশ্চিহ্ন হল। এরপরে হঠাৎ করে (সম্ভবতঃ বৃষ্টি শুরু হওয়ায়) এরা আবার পৃথিবী থেকে মিলিয়ে গেল।” (সিয়ার মুতাক্ষরীণ, ৩য় খণ্ড, গোলাম হোসেন, ইংরেজি অনুবাদ: মঁশিয়ে রেমণ্ড, পৃ- ২৬) তখন গ্রামে খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় সবই শুকিয়ে যাওয়ার ফলে মাঝে মাঝে এদিকে ওদিকে আগুন ধরে যেত, এবং তা থেকে বিশাল অগ্নিকাণ্ড ঘটত। উক্ত সময়ে ওই ধরণের অগ্নিকাণ্ডে বহু লোক পুড়ে মারা গিয়েছিলেন, এবং বহু শস্যের গোলাও আগুনের শিকার হয়েছিল। দিনাজপুর ও পূর্ণিয়া জেলার রাজগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ ও অন্যান্য কয়েকটি জায়গায় প্রচুর শস্যগোলা বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ ভস্মিভূত হয়ে গিয়েছিল। ওই সময়ের খাদ্যাভাব সম্পর্কে স্বয়ং 'মোহাম্মদ রেজা খাঁ' জানিয়েছিলেন যে, ১৭৭০ সালের আগেও বঙ্গদেশে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দিয়েছিল ঠিকই, তবে কষ্টকর হলেও তখন মানুষের পক্ষে খাদ্যশস্য জোগাড় করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ১৭৭০ সালের ওই দুর্ভিক্ষে সাধারণ মানুষ একেবারেই খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হননি। এই প্রসঙ্গে ১৭৬৯ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর তারিখে কলকাতার গভর্ণর ও কাউন্সিল লণ্ডনে ডিরেক্টর সভার কাছে জানিয়েছিলেন যে, বাংলা ও বিহারের অস্বাভাবিক খাদ্যাভাবের দরুন চলতি বছর ভূমি-রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ কম হতে পারে। তারপরে ঐ বছরেরই ২৩শে নভেম্বর তারিখে কলকাতা কাউন্সিল ডিরেক্টর সভাকে আরো জানিয়েছিল যে, “আমাদের সামনে শুধুখাদ্যাভাবের দুঃখজনক সম্ভাবনা এবং আগামী ছ'মাসে সেই দুঃখদুর্দশা আরো বেড়ে চলবে; কোনোমতেই এর প্রতিকারের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।” (ফিফথ রিপোর্ট, ১ম খণ্ড, হিস্টোরিক্যাল ইন্ট্রোডাকশন, ফারমিংগার সম্পাদিত, পৃ- ১৯৭) বাংলার তৎকালীন গভর্ণর জেন কার্টিয়ার' (১৭৬৯-৭২) ও তাঁর কাউন্সিলের সদস্যদের মতে, ওই দুর্ভিক্ষে মানুষের যে দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছিল, কোনো বর্ণনাই সেটাকে অতিরঞ্জিত করতে পারে না। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ২য় খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ৪৯) সর্বকালের সমস্ত দুর্ভিক্ষের মত ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মূল কারণটিও ছিল খাদ্যাভাব। ওই সময়ে মুর্শিদাবাদ দরবারে থাকা বৃটিশ রেসিডেন্টের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ১৭৭০ সালের জুন মাসে মুর্শিদাবাদে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে টাকায় ছয় বা সাত সের থেকে পরের মাসেই টাকায় তিন সের হয়ে গিয়েছিল। তখন সাধারণতঃ ওই সময়ের বাংলার বাজারে চালের স্বাভাবিক দাম ছিল টাকায় ২৮ সের, মোটা চাল ও অন্যান্য খাদ্যশস্য তখন টাকায় ৪৫ থেকে ৪২ সের পর্যন্ত পাওয়া যেত। সেই সময়কার খাদ্যাভাবের অপর দিকটি ছিল যে, তখন মাঝে মাঝেই বাজার থেকে খাদ্যশস্য একেবারে উধাও হয়ে যেত। ১৭৭০ সালের জুন মাসের দরবারের বৃটিশ রেসিডেন্ট (রিচার্ড বীচার) জানিয়েছিলেন যে, তৎকালীন বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ শহরের তিরিশ মাইলের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই কোন খাদ্যশস্য ছিল না। অনুরূপ অবস্থায় সেই সময়ের বাংলার অন্যান্য মফঃস্বল অঞ্চলের কথা সহজেই অনুমেয়। তখন কাজের অভাব এবং আয়ের অন্য কোনো পথ না থাকবার জন্য সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা ক্রমশঃই খারাপ হতে শুরু করেছিল। খাদ্যাভাবের ফলে বাংলার মানুষ তখন শাকপাতা, ফলমূল ও নানা রকমের অখাদ্য পর্যন্ত খেতে শুরু করে Nor rolling years from memory's page efface." (ফিফথ রিপোর্ট, ১ম খণ্ড, হিস্টোরিক্যাল ইন্ট্রোডাকশন,


ফারমিংগার সম্পাদিত, ভূমিকা) ১৭৭১ সালের ‘জেন্টলম্যান'স ম্যাগাজিন' ও ‘এ্যানুয়াল রেজিস্টারে', এবং চার্লস গ্রান্টের ‘অবজারভেশনস অন দি সেট অব সোসাইটি এমং দি এশিয়াটিক সাবজেক্টস অব গ্রেট বিট্রেন' (১৭৯৭) গ্রন্থে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সমকালীন বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৭৭০ সালের নভেম্বর মাসে ভাল ফসলের সম্ভাবনা দেখা দিলে কলকাতা কাউন্সিল ডিরেক্টর সভাকে বঙ্গদেশে দুর্ভিক্ষের অবসানের কথা জানিয়েছিল।


সমকালীন ব্যক্তিদের অনেকেই কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত-ব্যবসা, দুর্নীতিপরায়ণতা ও অবৈধ কাজকর্মকেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের জন্য অনেকাংশে দায়ী করেছিলেন। উক্ত সময়ে মুর্শিদাবাদ দরবারের থাকা বৃটিশ রেসিডেন্ট ‘ফ্রান্সিস সাইকস' (Francis Sykes) ও ‘রিচার্ড বীচার'কেও (Richard Becher) ওই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করা হয়েছিল। কোম্পানির কর্মচারীদের স্বার্থে লর্ড ক্লাইভ প্রতিষ্ঠিত একচেটিয়া ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘সোসাইটি ফর ট্রেড' (১৭৬৫)-কেও অনেকে বাংলার ওই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করেছিলেন। এরপরে কোম্পানির ডিরেক্টর সভার আদেশে পরের বছর থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সোসাইটি'কে তুলে দেওয়া হলেও, তারপরেও নানা অছিলায় ১৭৬৮ সাল পর্যন্ত সেটি নিজের কাজকর্ম চালিয়ে গিয়েছিল; এবং ১৭৬৮ সালের পরেও কোম্পানির কর্মচারীরা এই দেশীয় বেনিয়ান ও গোমস্তাদের মাধ্যমে বাংলার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে (লবণ, সুপারি, তামাক) নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছিলেন। কোম্পানির ডিরেক্টর সভার মতে কোম্পানির উচ্চপদস্থ Nor rolling years from memory's page efface." (ফিফথ রিপোর্ট, ১ম খণ্ড, হিস্টোরিক্যাল ইন্ট্রোডাকশন,


ফারমিংগার সম্পাদিত, ভূমিকা) ১৭৭১ সালের ‘জেন্টলম্যান'স ম্যাগাজিন' ও ‘এ্যানুয়াল রেজিস্টারে', এবং চার্লস গ্রান্টের ‘অবজারভেশনস অন দি সেট অব সোসাইটি এমং দি এশিয়াটিক সাবজেক্টস অব গ্রেট বিট্রেন' (১৭৯৭) গ্রন্থে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সমকালীন বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৭৭০ সালের নভেম্বর মাসে ভাল ফসলের সম্ভাবনা দেখা দিলে কলকাতা কাউন্সিল ডিরেক্টর সভাকে বঙ্গদেশে দুর্ভিক্ষের অবসানের কথা জানিয়েছিল।


সমকালীন ব্যক্তিদের অনেকেই কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত-ব্যবসা, দুর্নীতিপরায়ণতা ও অবৈধ কাজকর্মকেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের জন্য অনেকাংশে দায়ী করেছিলেন। উক্ত সময়ে মুর্শিদাবাদ দরবারের থাকা বৃটিশ রেসিডেন্ট ‘ফ্রান্সিস সাইকস' (Francis Sykes) ও ‘রিচার্ড বীচার'কেও (Richard Becher) ওই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করা হয়েছিল। কোম্পানির কর্মচারীদের স্বার্থে লর্ড ক্লাইভ প্রতিষ্ঠিত একচেটিয়া ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘সোসাইটি ফর ট্রেড' (১৭৬৫)-কেও অনেকে বাংলার ওই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করেছিলেন। এরপরে কোম্পানির ডিরেক্টর সভার আদেশে পরের বছর থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সোসাইটি'কে তুলে দেওয়া হলেও, তারপরেও নানা অছিলায় ১৭৬৮ সাল পর্যন্ত সেটি নিজের কাজকর্ম চালিয়ে গিয়েছিল; এবং ১৭৬৮ সালের পরেও কোম্পানির কর্মচারীরা এই দেশীয় বেনিয়ান ও গোমস্তাদের মাধ্যমে বাংলার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে (লবণ, সুপারি, তামাক) নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছিলেন। কোম্পানির ডিরেক্টর সভার মতে কোম্পানির উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালী কর্মচারীরা উক্ত দুর্ভিক্ষের বছরে সমস্ত খাদ্যশস্যের কেনা বেচার উপরে নিজেদের একচেটিয়া অধিকার স্থাপন করতে পেরেছিলেন। ফলে ওই সময়ে তাঁদের অবৈধ কাজকর্মের ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি। (ফিফথ রিপোর্ট, ১ম খণ্ড, হিস্টোরিক্যাল ইন্ট্রোডাকশন, ফারমিংগার সম্পাদিত, পৃ- ১৯৯) বলাই বাহুল্য যে, তখন বাংলার মানুষের অবর্ণনীয় দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে ওই সব কর্মচারীরা তাঁদের নিজেদের অর্থলিপ্সাকে পূরণ করেছিলেন। ফলে, ডিরেক্টর সভার মতে, এদেশের দুর্গত জনগণের প্রতি তাঁদের কোম্পানির সদয় মনোভাব (benevolence), এবং সমবেদনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষুন্ন হয়েছিল। ওই দুর্ভিক্ষের জন্য কোম্পানির ডিরেক্টর সভা (১৭৭১ সালের ২৯শে আগস্ট তারিখের চিঠি) রেজা খাঁকে দায়ী করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, দুর্ভিক্ষের বছরে তিনি বলপ্রয়োগ করে মুর্শিদাবাদগামী শস্য বোঝাই নৌকাগুলি আটক করে কম দামে প্ৰথমে শস্য ক্রয় ও মজুদ করেছিলেন, এবং পরে টাকায় ৩০ থেকে ২৫ সের চাল কিনে নিয়ে সেই চাল তিনি টাকায় তিন বা চার সের দরে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা করেছিলেন। ডিরেক্টর সভার বক্তব্য অনুসারে, তাঁর সেই অবৈধ ব্যবসা এবং লবণে একচেটিয়া ব্যবসার জন্য তৎকালীন বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। (ইতিহাসাশ্রিত বাংলা কবিতা, সুপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়, পৃ- ৮৬) সমকালীন সাহিত্যেও এর সাক্ষ্য পাওয়া যায় - “দেশের সমস্ত চাল কিনিয়া বাজারে। দেশ ছারখার হ'ল রেজা খাঁর তরে। একচেটে ব্যবসা দাম খরতর।


ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হ'ল ভয়ঙ্কর।” (ইতিহাসাশ্রিত বাংলা কবিতা, সুপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়, পৃ-

৮৬)

১৭৭২ সালে ডিরেক্টর সভার নির্দেশে পাঁচটি নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রেজা খাঁর বিচার হয়েছিল; সেইসব অভিযোগের মধ্যে মন্বন্তরের সময়ে অবৈধভাবে খাদ্যশস্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকা এবং মুনাফাবাজী অন্যতম প্রধান অভিযোগ ছিল। কিন্তু কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাও ওই ঘটনায় জড়িত থাকবার ফলে রেজা খাঁর বিরুদ্ধে সেইসব অভিযোগ অবশ্য প্রমাণিত হয়নি। ‘ইয়ংহাজবাণ্ড'

(Younghusband) নামে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ ভদ্রলোক ওই দুর্ভিক্ষের জন্য সমকালীন ইংরেজ বণিকদের দায়ী করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ১৭৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ট্রানসাকশনস ইন ইন্ডিয়া' গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন, “তাঁহাদের মুনাফা শিকারের পরবর্তী উপায় হইল চাউল কিনিয়া গুদামজাত করিয়া রাখা। তাঁহারা নিশ্চিত ছিলেন যে, জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য এই দ্রব্যটির জন্য তাঁহারা যে মূল্যই চাহিবেন তাহাই পাইবেন। ... চাষীরা তাঁহাদের প্রাণপাত করা পরিশ্রমের ফসল অপরের গুদামে মজুত হইতে দেখিয়া চাষবাস সম্বন্ধে উদাসীন হইয়া পড়িল। ইহার ফলে দেখা দিল খাদ্যাভাব। দেশে যাহা কিছু খাদ্য ছিল তাহা একচেটিয়া (ইংরাজ বণিকদের) দখলে চলিয়া গেল। খাদ্যের পরিমাণ যত কমিতে লাগিল ততই দাম বাড়িতে লাগিল। শ্রমজীবী, দরিদ্র জনগণের চিরদুঃখময় জীবনের উপর পতিত হইল এই পূঞ্জীভূত দুর্যোগের প্রথম আঘাত। কিন্তু ইহা এক অশ্রুতপূর্ব বিপর্যয়ের আরম্ভমাত্র। এই হতভাগ্য দেশে দুর্ভিক্ষ কোনো অজ্ঞাতপূর্ব ঘটনা

নহে। কিন্তু দেশীয় জনশত্রুদের সহযোগিতায় একচেটিয়া শোষণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তির অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ যে বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখা দিল তাহা এমনকি ভারতবাসীরাও আর কখনও চোখে দেখেন নাই বা শুনেন নাই। চরম খাদ্যাভাবের এক বিভীষিকাময় ইঙ্গিত লইয়া দেখা দিল ১৭৬৯ খৃষ্টাব্দ। সঙ্গে সঙ্গে বাঙলা ও বিহারের সমস্ত ইংরাজ বণিক, তাঁহাদের সকল আমলা- গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী, যে যেখানে নিযুক্ত ছিল সেইখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান, চাউল ক্রয় করিতে লাগিল। এই জঘন্যতম ব্যবসায় মুনাফা হইল এত শীঘ্র ও এরূপ বিপুল পরিমাণে যে, মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে নিযুক্ত একজন কপর্দকশূন্য ভদ্রলোক এই ব্যবসা করিয়া দুর্ভিক্ষ শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৬০ হাজার পাউণ্ড (দেড় লক্ষাধিক টাকা) য়ুরোপে পাঠাইয়া ছিলেন।” (ট্রানসাকশনস ইন ইন্ডিয়া, ইয়ংহাজবাণ্ড, পৃ: ১২৩-২৪; ভারতের কষেক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, ১ম খণ্ড, সুপ্রকাশ রায়, পৃ: ১৩-১৪) ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পিছনে অনেকগুলি কারণ ছিল। প্রথমতঃ, সেই সময়ের দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা (masked system); হেস্টিংস সেই সমস্যার মূলে গিয়ে সেটির আসল চরিত্রটি উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এবং, সেই সময়ের প্রশাসনিক দুর্বলতা - ইংরেজদের রাজস্বের অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করেও শাসন ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব না নেওয়া। এই দুটিকেই ওই দুর্ভিক্ষের প্রাথমিক কারণ বলে ধরা যেতে পারে। হেস্টিংসের নিজের ভাষায়, “ want of a principle of government adequate to the substance of responsibility" - অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার সেই - বিপর্যয়ের জন্য অনেকখানি দায়ী ছিল। এমনকি বাংলার গভর্ণর ‘হ্যারি ভেরেলস্ট' (Harry Verelst) এদেশ থেকে বিদায় নেওয়ার সময়ে যে নোট লিখে রেখে গিয়েছিলেন, তাতেও তখনকার সেই প্ৰশাসনিক দুর্বলতার উল্লেখ পাওয়া যায়। বণিক মনোবৃত্তি নিয়ে শুধু রাজস্ব আদায় করা, অথচ সেই রাজস্ব যাঁরা দেন তাঁদের রক্ষার দায়িত্ব না নেওয়াকে তিনি পরস্পর বিরোধী, জাতীয় চরিত্রের পক্ষে ক্ষতিকর, এদেশের প্রশাসনিক উন্নতির প্রতিবন্ধক, এবং প্রায় অমানবিক বলে উল্লেখ করেছিলেন। (ফিফথ রিপোর্ট, ১ম খণ্ড, হিস্টোরিক্যাল ইন্ট্রোডাকশন, ফারমিংগার সম্পাদিত, ভূমিকা ও পৃ- ২১০) সমকালীন কলকাতায় কাউন্সিল ও সিলেক্ট কমিটির মধ্যে বিরোধ, এবং গভর্ণর ‘জন কার্টিয়ারের’ (John Cartier) অপদার্থতাও ওই দুর্ভিক্ষের সময়ে জনগণের দুর্দশা লাঘবের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। তৎকালীন গভর্ণর সম্পর্কে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার ‘টি. ডি. পিয়ার্স'

(Pearse) লিখেছিলেন, “কার্টিয়ার একজন মানুষ ভাল, খুব মিশুকে তবে তার পদের চেয়ে অনুপযুক্ত। কম কর্ম ক্ষমতাসম্পন্ন বা দৃড়তাসম্পন্ন মানুষ আগে কেউ গভর্ণর হননি।” (“a man of good character, and amiable in the extreme but there never was a governor less capable, less active, less resolute.” ফিফথ রিপোর্ট, ১ম খণ্ড, হিস্টোরিক্যাল ইন্ট্রোডাকশন, ফারমিংগার সম্পাদিত, পৃ-২০৩) দ্বিতীয়তঃ, ওই দুর্ভিক্ষের বছরে খাদ্যাভাবের সঙ্গে মুদ্রাভাবও যুক্ত হয়েছিল। তৎকালীন বাংলার বাজারে রৌপ্য মুদ্রা সিক্কার অভাব স্বাভাবিক বাণিজ্যিক কাজকর্মকে প্রায় অচল করে তুলেছিল। সেই মুদ্ৰা সংকটের সমাধান করবার জন্য ক্লাইভ ও ভেরেলস্ট সোনার মোহরকে বৈধ মুদ্রা হিসাবে চালানোর একটা চেষ্টা করেছিলেন। তবে কুড়ি ক্যারাটের সোনার মোহর (১৬ আনা ওজন) ১৪ সিক্কা টাকা দাম ধার্য হওয়ার জন্য সমকালীন বাজারে সোনা রূপোর দামে আনুপাতিক হারের চেয়ে সোনার মোহরের দাম বেশি হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে তখনকার মুদ্রাসংকট কাটেনি। তৃতীয়তঃ, দ্বৈত শাসন পর্বে (১৭৬৫-৭২) বাংলার রাস্তাঘাট ও নদীপথগুলি ক্রমশঃ খারাপ হতে শুরু করেছিল। ভাল পথ ও পরিবহনের অভাবে দুর্ভিক্ষের সময়ে বাংলায় একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দ্রুত খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়াও সম্ভব হয়নি। চতুর্থতঃ, তখন প্রশাসনিক আদেশ জারি করে বাংলা ও বিহারকে পৃথক খাদ্যাঞ্চল হিসাবে গঠন করা হয়েছিল। এর ফলে বাংলা থেকে বিহার বা বিহার থেকে বাংলার খাদ্যশস্য দেওয়া নেওয়া করা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। এমনকি তৎকালীন বাংলার জেলাগুলির মধ্যেও খাদ্যশস্য চলাচলের উপরে অনুরূপ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। তখন একজেলা থেকে অন্য জেলায় খাদ্যশস্য বহন করা নিষিদ্ধ হয়েছিল। শুধুমাত্র রাজধানী মুর্শিদাবাদে খাদ্যশস্য নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না। তখন ওরকম বাধা নিষেধ চালু থাকবার ফলে কোম্পানির কর্মচারী ও তাঁদের এদেশী বেনিয়ানদের পক্ষে খাদ্যশস্যের বাজার কুক্ষিগত করা আরো সহজ হয়েছিল। (দি এগ্রেরিয়ান সিস্টেম অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এ. সি. ব্যানার্জী, পৃ- ১৩০) উক্ত প্রসঙ্গে ‘অ্যাডাম স্মিথ’ তাঁর ‘ওয়েলথ অব নেশনস' (Wealth of Nations) গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছিলেন, “কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে যে খরা গেল তার ফলে বড় রকমের খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার কথা: কোম্পানির কর্মচারীরা খাদ্য ব্যবসায়ীদের উপর কতকগুলি অন্যায় নিয়মরীতি এবং অবিবেচনাপ্রসূত বাধানিষেধ আরোপ করার ফলে ঐ খাদ্যাভাব দুর্ভিক্ষে পরিণত হল।” (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ২য় খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ৫৮) পঞ্চমতঃ, ইংরেজ সরকার ওই দুর্ভিক্ষের শুরুতেই চাল মজুদ করতে শুরু করে দিয়েছিল। চার্লস গ্রান্টের হিসাব অনুযায়ী সেই সময়ে সরকার শুধুমাত্র কলকাতার সেনাবাহিনীর জন্যই ৬০,০০০ মণ চাল মজুদ করেছিল। ইংরেজদের উপরে নির্ভরশীল অন্যান্যদের জন্যও তখন কর্তৃপক্ষের দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না। দুর্ভিক্ষের বছরে কলকাতায় কিন্তু খাদ্যশস্যের বিশেষ কোনো অভাব হয়নি। (আধুনিক গবেষণার প্রমাণিত হয়েছে যে, ১৯৪৩
সনের মন্বন্তরের সময়েও বাংলার মফঃসম্বল অঞ্চল ও অন্যান্য জায়গা থেকে প্রচুর খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে কলকাতার সেনাবাহিনী ও অন্যান্যদের জন্য মজুদ করা হয়েছিল।) অথচ সেই খাদ্যশস্য সরবরাহ করতে গিয়ে বাংলার মফঃস্বল অঞ্চল একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। বাংলার রাজমহল ও ভাগলপুর জেলার সমস্ত শস্য মুঙ্গেরে সেনানিবাসের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। ষষ্টতঃ, ওই সময়ে মুর্শিদাবাদ দরবারে থাকা বৃটিশ রেসিডেন্ট স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ওই দুর্ভিক্ষের সময়ে রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে যত বেশি কড়াকড়ি করা হয়েছিল, এর আগে রাজস্ব আদায়ে তত বেশি কড়াকড়ি আর কখনো করা হয়নি। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া, ১ম খণ্ড, রমেশচন্দ্র দত্ত, পৃ- ৫১) সেই সময়ের বাংলার নায়েব দেওয়ান রেজা খাঁ ও তাঁর অধীনস্থ আমিলরা, এবং ইংরেজ সুপারভাইজররা তাঁদের নিজের নিজের প্রভুকে সন্তুষ্ট করবার জন্য বলপ্রয়োগ করে রাজস্ব আদায় করেছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময়ে লোকসংখ্যা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের প্রাপ্য রাজস্বের পরিমাণ কম হওয়ার কথা থাকলেও, বঙ্গদেশে দুর্ভাগ্যবশতঃ সেটার বিপরীত ঘটনা ঘটেছিল। অর্থাৎ ওই দুর্ভিক্ষের বছরে সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় কিছুটা হলেও বেড়ে গিয়েছিল। পরে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সেটার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন যে, ওই সময়ের সরকারি প্রশাসন ও কর সংগ্রাহকরা বল প্রয়োগ করে আদায়ী রাজস্বের পরিমাণ আগের মত বজায় রেখেছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময়ে চার বছরের আদায়ীকৃত রাজস্বের হিসাব থেকেও হেস্টিংসের সেই সিদ্ধান্ত সমর্থিত হয়। (ফিফথ রিপোর্ট, ১ম খণ্ড, হিস্টোরিক্যাল ইন্ট্রোডাকশন, ফারমিংগার সম্পাদিত, পৃ- ২১০) ১৭৬৮-৬৯ সালে (১১৭৫ বঙ্গাব্দে) সংগৃহিত রাজস্বের পরিমান ছিল ১,৫২,৫৪,৮৫৬ টাকা, ১৭৬৯-৭০
সালে (১১৭৬ বঙ্গাব্দে) ছিল ১,৩১,৪৯,১৪৮ টাকা; ১৭৭০-৭১ সালে (১১৭৭ বঙ্গাব্দে) ছিল ১,৪০,০৬,০৩০ টাকা; এবং ১৭৭১-৭২ সালে (১১৭৮ বঙ্গাব্দে) ছিল ১, ৫৩,৩৩,৬৬০ টাকা। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রকোপ, তীব্রতা বা ব্যাপকতা ওই সময়ের বঙ্গদেশের সব জেলায় সমানভাবে অনুভূত হয়নি। সেই দুর্ভিক্ষে বাংলার যে জেলাগুলি তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেগুলি ছিল - পূর্ণিয়া (উক্ত সময়ে পূর্ণিয়া, ভাগলপুর ও রাজমহল বাংলার মধ্যে ছিল), নদীয়া, রাজশাহী, বীরভূম, পাচেট (রাণীগঞ্জ), বর্ধমান জেলার উত্তর ও পশ্চিমভাগ, ভাগলপুর, রাজমহল, হুগলী, যশোহর, মালদা ও চব্বিশ পরগনা। পূর্ণিয়া জেলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রত হয়েছিল। এমনিতে স্বাভাবিক সময়েও ওই জেলাটি তখন শুষ্ক থাকত; সেখানে জলসেচের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তার উপরে পর পর তিনবছর বৃষ্টি না হওয়ার জন্য ওই জেলার কৃষকেরা সেবারে একেবারেই কোন শস্য পাননি। তৎকালীন পূর্ণিয়ার সুপারভাইজার ‘ডুকারেলের’ (G. G. Ducarel) হিসেব অনুযায়ী, উক্ত দুর্ভিক্ষের বছরে ওই জেলার মোট লোক সংখ্যার অর্ধেক, প্রায় দু'লক্ষ লোক নিজের প্রাণ হারিয়েছিলেন; এবং, পুরো একবছর ধরে সেখানে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ স্থায়ী হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের বছরে নদীয়া জেলার কৃষিকাজ ও খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল; কারণ, আর্থিক দুরবস্থার জন্য নদীয়ার জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র রায় সেবারে কৃষকদের কোন কৃষিঋণ (তাকাবি) দিতে পারেননি। সমকালীন বাংলার অপর ক্ষতিগ্রস্ত জেলাটি ছিল রাজশাহী। ওই সময়ে সেখানকার প্রাণহানি, চাষের ক্ষতি, এবং বাণিজ্যের অবনতি সমকালীন ব্যক্তিদের নজরে পড়েছিল। বীরভূম, পাচেট ও বর্ধমানের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল এমনিতেই তখন শুষ্ক ছিল। তার উপরে অনাবৃষ্টিতে ঐসব অঞ্চলে তখন হাহাকার পড়ে গিয়েছিল, এবং বহু প্রাণহানি

ঘটেছিল। বীরভূমে মৃত্যু ও গৃহত্যাগের ফলে বহু গ্রামই তখন রাতারাতি জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই তখন ওই জেলার শহরগুলিতে বহুবাড়ি জনশূন্য অবস্থায় দিনের পর দিন পড়ে থাকতে দেখতে দেখেছিলেন। দুর্ভিক্ষে ভাগলপুর জেলার অর্ধেক লোক মারা গিয়েছিলেন, এবং তিন চতুর্থাংশ জমি জঙ্গল বা অনাবাদী হয়ে গিয়েছিল। তখন ভাগলপুর ও রাজমহলের প্রায় সব জমি সরকারের খাসে চলে গিয়েছিল। কোনো ইজারাদার সেগুলির ভূমি-রাজস্বের ইজারা নিতে রাজী হননি। হুগলী, মালদা, যশোর ও চব্বিশ পরগনার শস্যহানি ও মৃত্যুর হার তখন এত বেশি হয়েছিল যে, দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরগুলিতেও বঙ্গদেশে কৃষি ও লবণ তৈরীর কাজে শ্রমিকের সরবরাহ কমে গিয়েছিল। এছাড়া দিনাজপুর জেলার পশ্চিমাংশ, ঢাকা জেলার কিছু অংশ, মেদিনীপুর ও রংপুর জেলার কতকাংশেও ওই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। (হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ৩য় খণ্ড, এন. কে. সিংহ সম্পাদিত, পৃ-৮৮) ঢাকার উত্তরাঞ্চলের কিছু নীচু এলাকা জলমগ্ন হওয়ার ফলে তখন শস্যহানি ঘটলেও, দুর্ভিক্ষের বছরে ঢাকা মুর্শিদাবাদ ও কলকাতায় খাদ্যশস্য সরবরাহ করেছিল। মেদিনীপুরে আবার খরার সঙ্গে তখন পঙ্গপাল বা অন্যান্য শস্যহানিকর পোকামাকড়ের উপদ্রব দেখা দিয়েছিল। উক্ত সময়ে মেদিনীপুরে এত বেশি প্রাণহানি হয়েছিল যে, পরবর্তীকালে লবণ উৎপাদন ও অন্যান্য উৎপাদন মূলক কাজকর্মের জন্য সেখানে শ্রমিক ও মজদুর পাওয়া রীতিমত দুঃসাধ্য হয়ে গিয়েছিল। বাখরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, শ্রীহট্ট, কুচবিহার, ত্রিপুরা ও ঢাকার দক্ষিণাঞ্চল সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্ত ছিল। তবে প্রত্যক্ষভাবে দুর্ভিক্ষের কবলে না পড়লেও তখন সারা বঙ্গদেশে ব্যাপক খাদ্যাভাব থাকবার ফলে ওই সমস্ত জেলা থেকে ক্রমাগত খাদ্যশস্য রপ্তানির ফলে ওই অঞ্চলের
লোকজনও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন বলা চলে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাংলার দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষকে রক্ষা করবার জন্য গৃহীত সব ব্যবস্থাই সমকালীন ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজদের চোখে অমানবিকভাবে অপ্রতুল (inhumanly inadequate) বলে বোধ হয়েছিল। (হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ৩য় খণ্ড, এন. কে. সিংহ সম্পাদিত, পৃ - ৮৮) ১৮০০ সালের আগে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষ দুর্ভিক্ষের মোকাবিলার জন্য বঙ্গদেশের কোথাও কোন সরকারি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি কিন্তু কাউন্সিলের মতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ নাকি সেই বিষয়ে যথাসাধ্য ব্যবস্থা করেছিল। (লেটার টু কোর্ট, ২৩শে নভেম্বর ১৭৬৯ সাল) এই প্রসঙ্গে ১৭৬৯ সালের ২৩শে নভেম্বর তারিখে কলকাতা কাউন্সিল লণ্ডনের ডিরেক্টর সভাকে লিখেছিল, “এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে বিপন্ন বাংলার মানুষের ত্রাণের জন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি, এবং আমাদের সাধ্যমত ব্যবস্থা নেব।” (“We have taken and shall pursue every means in our power to relieve the miserable situation the poor inhabitants must be involved in from this dreadful calamity") ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের ত্রাণের জন্য তৎকালীন বাংলার নবাব সরকার ও ইংরেজ কোম্পানি যে ব্যবস্থাগুলি নিয়েছিল, সেগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে - (ক) দুর্ভিক্ষ ত্রাণে সাহায্য ও খাদ্য বিতরণ, (খ) ভূমিরাজস্ব আদায় স্থগিত ও মকুব, (গ) কৃষি ঋণ (তাকাবি) দেওয়ার ব্যবস্থা। (দি এগ্রেরিয়ান সিস্টেম অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এ. সি. ব্যানার্জী, পৃ- ১৩০) উইলিয়ম হান্টারের হিসেব অনুযায়ী ওই সময়ে সারা বাংলা ও বিহারের তিনকোটি দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের ত্রাণের জন্য সরকার মাত্র নব্বই হাজার টাকা খরচ করেছিল। নায়েব

দেওয়ান রেজা খাঁয়ের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে তখন দুর্ভিক্ষ ত্রাণের জন্য মুর্শিদাবাদে যে তহবিল গঠন করা হয়েছিল, তাতে কোম্পানি ৪০,০০০ টাকা; নবাব মুবারক-উদদৌলা ২৬,৮৯৩ টাকা; রেজা খাঁ স্বয়ং ১৯, ৬০৭ টাকা; রায় দুর্লভ ৬,০০০ টাকা; এবং জগৎশেঠ ৬, ৩৭৫ টাকা দান করেছিলেন। কিন্তু সেই টাকা অপ্রতুল মনে হওয়ার জন্য তখন আরো ৬৫,১৯৩ টাকা দুর্ভিক্ষ ত্রাণে ব্যয় করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে মোট টাকার পরিমাণ ছিল ১,৫২,৪৪৩ টাকা। কিন্তু তিনকোটি দুর্ভিক্ষ- পীড়িত মানুষের ত্রাণের জন্য সেই টাকাকে কোনমতেই যথেষ্ট বলা চলে না। রেজা খাঁ মুর্শিদাবাদে বুভুক্ষু মানুষকে খাওয়ানোর জন্য, এবং ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য সাতটি কেন্দ্র খুলেছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে মাথাপিছু একসের করে চাল বিতরণ করা হত। তৎকালীন মুর্শিদাবাদ শহরে দৈনিক সাত হাজার লোক ওই সরকারি লঙ্গরখানায় আহার করতেন। (কার্টিয়ার, ননীগোপাল চৌধুরী, পৃ- ৬১) ঠিক একই ভাবে ওই সময়ে ত্রাণ বিতরণ ও ক্ষুধার্তদের বাঁচাবার জন্য পূর্ণিয়া, দিনাজপুর, রাজমহল, বীরভূম ও হুগলীতে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। তখনকার বাংলার ধনীদের অনেকেও, এবং জমিদারদের মধ্যে কেউ কেউ দুর্ভিক্ষ- পীড়িত মানুষদের সাহায্য করেছিলেন। ‘গোপীমণ্ডল’ নামে দিনাজপুরের একজন ব্যবসায়ী দুর্ভিক্ষের সময়ে গরীবদের খাওয়ানোর জন্য ৫০,০০০ টাকা দান করেছিলেন। (দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ২য় খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ৫৬) নবাব দরবারে বৃটিশ রেসিডেন্ট তখন বাংলার অভিজাতদের সেই দাতব্য কাজকর্মের প্রশংসা করেছিলেন। বিহার অঞ্চলের নায়েব দেওয়ান ‘সীতাব রায়’ও ওই সময়ের দুর্গত মানুষদের খাওয়ানোর জন্য ভাল ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি বেনারস থেকে সস্তায় চাল আনিয়ে ৩০,০০০ টাকার চাল ক্ষুধার্ত
মানুষদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। বস্তুতঃ তখন, বিহারে খাদ্য বিতরণ ও ত্রাণব্যবস্থা বঙ্গদেশের চেয়ে ভাল হয়েছিল। (সিয়ার মুতাক্ষরীণ, ২য় খণ্ড, গোলাম হোসেন, ইংরেজি অনুবাদ: মঁশিয়ে রেমন্ড, ৫৬-৫৭) দুর্ভিক্ষের বছরে ইংরেজ ও ওলন্দাজ বণিকেরাও ক্ষুধার্ত ও নিরাশ্রয় মানুষদের অনেককে খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছিলেন। বিহারে তাঁরা সীতাব রায়ের ত্রাণ ব্যবস্থাকেই অনুসরণ করেছিলেন। দুর্ভিক্ষের বছরে (১৭৬৯-৭০) কোম্পানি ৮,০৩,৩২১ টাকার ভূমিরাজস্ব মকুব করেছিল। সেই টাকা ঐ বছরে মোট সংগৃহীত ভুমিরাজস্বের ৬ শতাংশ ছিল। এরপরে ১৭৭০-৭১ সালেও ১৫,০৮,০৩২ টাকার ভূমিরাজস্ব বা মোট রাজস্বের প্রায় ১১ শতাংশ মকুব করা হয়েছিল। কোনো কোনো অঞ্চলে মকুব করা রাজস্বের পরিমাণ অবশ্য আরো বেশি ছিল। বীরভূম জেলায় তখন যে ভূমিরাজস্ব মকুব করা হয়েছিল, সেটার পরিমাণ ছিল ঐ জেলার মোট ভূমিরাজস্বের প্রায় ৪৫ শতাংশ। পূর্ণিয়া জেলায় ৬ ৫০ শতাংশ, এবং রাজমহলে ২৮ শতাংশ রাজস্ব মকুব করা হয়েছিল। (কার্টিয়ার, ননীগোপাল চৌধুরী, পৃ: ৬৪- ৬৫) যদিও হান্টার সাহেবের হিসাবমত দুর্ভিক্ষের বছরে মাত্র ৫ শতাংশ ভূমিরাজস্ব মকুব করা হয়েছিল; এবং পরের বছর সেই ভূমিরাজস্ব ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়ে আগের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া হয়েছিল। (দি এ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল, ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার, পৃ: ৩৭-৪০) এই প্রসঙ্গে হান্টার সাহেব আরো লিখেছিলেন যে, “বস্তুতঃপক্ষে তখন এক লক্ষেরও কম টাকা বা ৮, ২১৮ পাউন্ড মকুব করা হয়েছিল। পরের বছরের শুরুতে সেটাও শোধ দিতে হয়েছিল।” সুতরাং একথা বলা বোধহয় অসঙ্গত হবে না যে, ওই সময়ে কোম্পানির ভূমিরাজস্ব মকুব করবার ফলে বাংলার দুর্দশাগ্রস্ত কৃষক বা কৃষির কোন রকমের সুবিধা হয়নি। এর আগে মোঘল
ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় দুর্ভিক্ষের বছরে রাজস্ব মকুব করবার প্রথা চালু থাকলেও, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ে সেই প্রথা কিন্তু যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। কোম্পানি দুর্ভিক্ষের বছরে (১৭৬৯-৭০) চাষের ব্যবস্থা করবার জন্য টাকায় দু' আনা বা ১২.৫০ শতাংশ হারে কৃষকদের অগ্রিম কৃষিঋণ (তাকাবি) দিয়েছিল। তখন মুর্শিদাবাদের কোষাগার থেকে বাংলার এগারোটি জেলার জন্য মোট ২,৭৬,৫৪৭ টাকা কৃষিঋণ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে সেই সময়ের ছয়টি জেলা যে হারে তাকাবি পেয়েছিল, সেটা হল - বীরভূম: ২০,০০০, রাজশাহী: ৫০, ০০০, নদীয়া: ৩০,০০০, দিনাজপুর: ৪৫,০০০, পূর্ণিয়া: ৬৯,০৪৭, এবং রংপুর: ৩৫,০০০ টাকা। বিহারে মোট ১, ০৬,৪৮৯ টাকার কৃষিঋণ দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন বাংলার বিপর্যস্ত কৃষি ও কৃষকদের প্রয়োজনের অনুপাতে ওই টাকার পরিমাণ যে খুবই সামান্য ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। উক্ত সময়ে বাংলার জমিদারদের অনেকের আর্থিক অবস্থাও বেশ খারাপ হয়ে যাওয়ার ফলে তাঁরা কৃষকদের কোন তাকাবি দিতে পারেন নি; আর সরকারের দেওয়া কৃষিঋণের সবটাই তখন কৃষকদের হাতে পৌঁছেছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন না। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ওই সময়ে নদীয়ার সুপারভাইজার ‘জে, রাইডার' (J. Rider) মুর্শিদাবাদ কাউন্সিলকে জানিয়েছিলেন যে, নদীয়ার জমিদার তাকাবির টাকা কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করেননি। রাজশাহীর কৃষকেরাও তাকাবির পুরো টাকা পাননি বলে ‘বাফটন রাউস' (Boughton Rous) কাউন্সিলকে জানিয়েছিলেন। (কার্টিয়ার, ননীগোপাল চৌধুরী, পৃ- ৬৭) ছিয়ত্তরের মন্বন্তর ওই সময়ের বাংলার অর্থনীতি, বিশেষ করে, কৃষি অর্থনীতির উপরে গভীর ও সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেই দুর্ভিক্ষে বাংলার এক কোটি লোক প্রাণ হারানোর ফলে বাংলায় এক তৃতীয়াংশ
জমি জঙ্গল বা অনাবাদী হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে বঙ্গদেশের কৃষিউৎপাদন হ্রাস ও খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। হান্টার সাহেবের মতে, ওই সময় (১৭৭০ সাল) থেকেই বাংলার অভিজাতদের দুই-তৃতীয়াংশের অবক্ষয় বা ধ্বংস শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৭৭৫ সালে লর্ড হেস্টিংস বাংলার জমিদারদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, “বাংলার জমিদারদের কেউই আর অবস্থাপন্ন নন। তাঁদের জমিদারি বিক্রি করা ছাড়া আর কোনোভাবেই তাঁদের কাছ থেকে পাওনা বকেয়া টাকা আদায় করবার পথ নেই।” (ফিফথ রিপোর্ট, ১ম খণ্ড, হিস্টোরিক্যাল ইন্ট্রোডাকশন, ফারমিংগার সম্পাদিত, ভূমিকা, পৃ- ২১৯) উক্ত সময়েই নাটোরের ‘রানী ভবানী' নিয়মিতভাবে রাজস্ব দিতে না পারবার জন্য তাঁর জমিদারি কেড়ে নেওয়া হবে বলে তাঁকে ভয় দেখানো হয়েছিল। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র খাজনা দিতে না পারার জন্য তাঁর জমিদারি কেড়ে নিয়ে তাঁর পুত্র ‘শিবচন্দ্র’কে বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়েছিল। একই সময়ে বীরভূম ও বিষ্ণুপুরের রাজারা সময়মত সরকারি রাজস্ব জমা দিতে না পারার জন্য কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। ওই সময়ের অনেক ইজারাদার সময়মত রাজস্ব দিতে না পারার জন্য আর ইজারা পান নি। তখন পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, বর্ধমানের রাজাকে পর্যন্ত নিজের পারিবারিক সোনারুপোর তৈজসপত্র বিক্রি করে, এবং সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তাঁর পিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়েছিল। (দি এ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল, ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার, পৃ- ৫৭) কোম্পানি ঠিক ওই রকম সময়েই বর্ধিত রাজস্বের ভিত্তিতে (রসদ) জমিদারি নিলামে চড়িয়ে উচ্চহারে পাঁচবছরের জন্য ভূমি-রাজস্বের নতুন বন্দোবস্ত করেছিল (১৭৭২)। ১৭৭০-৭১ সালে সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ ও খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্য দেখে জমিদার ইজারাদারেরা সেই
উচ্চহারে জমির বন্দোবস্ত নেওয়ার অল্পকাল পরেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যাওয়ার ফলে জমি ও কৃষকের আনুপাতিক হারে হঠাৎ পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। সেই সময়ে বাংলার চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বেশি হলেও, তাতে চাষ করবার লোকের সংখ্যা কম ছিল। এর ফলে ওই সময়ের জমিদার ও কৃষকদের মধ্যেকার সম্পর্কের ক্ষেত্রেও স্বল্পকালস্থায়ী পরিবর্তন এসেছিল। লোকের অভাবে ওই দুর্ভিক্ষের পরেও অনেক জমি দীর্ঘসময় ধরে অনাবাদী বা জঙ্গলে পরিণত হয়ে পড়ে ছিল। ১৭৭৬ সালেও বাংলার মোট কৃষিজমির অর্ধেকেরও বেশি অনাবাদী হয়ে পড়ে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তখন জমির চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে ভূমি রাজস্বের হারও কমতে শুরু করেছিল। সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে 'পাইকস্ত রায়ত'রা (অস্থায়ী রায়ত) সুবিধালাভ করেছিলেন। জমিদারেরা তখন সুবিধাজনক শর্তে কম রাজস্বহারে তাঁদের জমি চাষ করতে দিয়েছিলেন। অপরদিকে ‘খোদকস্ত রায়ত’দের অধিকার ও দায়িত্ব স্থায়ী হওয়ায় তাঁদের ক্ষেত্রে কিন্তু ভূমিরাজস্বের হার তৎকালীন বাজার অনুযায়ী বেশি হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে তাঁরা অনেকেই নিজেদের জোত ছেড়ে অন্যত্র অল্পহারে ভূমি বন্দোবস্ত নিতে শুরু করেছিলেন। ওই সময়ে খোদকস্ত রায়তদের পাইকস্ত হওয়ার পেছনে আরো একটি আর্থিক কারণ ছিল যে, সরকার মন্বন্তরের পরেই ‘নাজাই' (najai) কর ধার্য করে তখন যাঁরা মারা গিয়েছিলেন বা পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের দেয় রাজস্ব জীবিতদের উপরে চাপিয়ে দিয়েছিল। সেই করের চাপও রক্ষণ খোদকস্ত রায়তদের উপরে গিয়ে পড়েছিল। ফলে অনেক খোদকস্ত রায়ত তখন স্বেচ্ছায় পাইকস্ত রায়তে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরে পাইকস্ত রায়তদের প্রাধান্য
বাংলার কৃষি অর্থনীতির নতুন বৈশিষ্ট্য ছিল। আর প্রকৃতি যতদিন না সেই শূন্যতা পূরণ করেছিল, ততদিন পর্যন্ত জমির জন্য কৃষকদের মধ্যে আর কোন প্রতিযোগিতা দেখা যায়নি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার শিল্প পণ্য উৎপাদকদের একাংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা ছিলেন বাংলার তাঁতি, রেশম শিল্পী, গুটি পোকার পালক, সোনা প্রস্তুতকারক, দুণের মজুর, লবণ উৎপাদক মালঙ্গি প্রভৃতি। উক্ত সময়ে নৌকামাঝি, গাড়ির চালক ও অন্যান্য শ্রেণীর শ্রমিকদের অনেকেই নিজের প্রাণ হারিয়েছিলেন। ফলে সামগ্রিকভাবে শিল্প উৎপাদন তখন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরগুলিতে রেশম ও বস্ত্রের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার ফলে সেসবের দামও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তখন বাংলায় খাদ্যশস্য ও শ্রমের দামও বেড়ে গিয়েছিল। এর ফলে তৎকালীন বঙ্গদেশে উৎপন্ন অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের (চিনি, লবণ, চাল, তেল, সুপারি, পান, তামাক ইত্যাদি) দামও বেড়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে বিশাল সংখ্যক কুশলী কারিগরের মৃত্যু হওয়ার জন্য বাংলার শিল্প পণ্যের গুণগতমানেও অবনমন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সমকালীন ইংরেজ ও অন্যান্য বিদেশী কোম্পানির কাগজপত্রেও সেই যুগের বাংলায় উৎপন্ন পণ্যের গুণগতমানের ক্রমশঃ নিম্নগামী হওয়ার কথা পাওয়া যায়। তবে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সবচেয়ে বড় সামাজিক কুফল ছিল বাংলায় প্রশাসনিক অব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রাচীন ব্যবস্থা ওই সময়ে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিল। বাংলার উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে দস্যুবৃত্তি ও দলবদ্ধভাবে লুঠের ঘটনাও তখন অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। কোচবিহার, ত্রিহুত ও মোরাং অঞ্চল থেকে দলবদ্ধ সন্ন্যাসী ও ফকির দস্যুরা বাংলার উত্তরাঞ্চলে নতুন গজিয়ে ওঠা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে দস্যুবৃত্তি করতে শুরু করেছিলেন। বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতেও তখন তাঁরা হানা
দিয়েছিলেন। (সেই সময়কার বীরভূম অঞ্চলের সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ কাহিনী নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ' রচিত হয়েছিল।) বাংলার উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা অনেকেই সেই দস্যুদলের সঙ্গে যোগ দিয়ে তখন লুঠতরাজ করে বেড়িয়েছিলেন। উক্ত সময়ে কোনো কোনো অঞ্চলে ডাকাতি ও লুঠতরাজ তো রীতিমত কৃষক বিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল। তবে ওই সময়ে দিনাজপুর, পূর্ণিয়া, বর্ধমান, হুগলী ও যশোহর জেলাতেই সেই লুঠতরাজের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ছিল। গ্রামের পাইক ও থানাদাররা তাঁদের বাধা দিতে পারেন নি। ফলে ওয়ারেন হেস্টিংসকে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে ওই সমস্ত দস্যুদলকে দমন করতে হয়েছিল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাংলার সমাজ জীবনধারাকেই শুধু আঘাত করেনি, বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত ব্যবস্থাকেও একেবারে ভেঙ্গে দিয়েছিল। বাংলার সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনের স্থিতিশীলতা ও সংহতি তখন নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের তাড়নায় ভাগলপুর ও রাজমহলের লোকেরা তখন উত্তরের পাহাড়ী অঞ্চলে খাদ্যান্বেষণে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর দুর্ভিক্ষ অন্তে যখন তাঁরা স্বগ্রামে ফিরে এসেছিলেন, তখন পাহাড়ীদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে কাটানোর অপরাধে তাঁদের জাত গিয়েছিল। (হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ২য় খণ্ড, এন. কে. সিংহ, পৃ- ৬৩) তাঁরা তখন দস্যুবৃত্তিকে নিজেদের পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ এই প্রসঙ্গে ১৭৭১ সালে রাজসাহীর সুপারভাইজর লিখেছিলেন, “অনেক কৃষক যাঁরা এতদিন প্রতিবেশীদের কাছে সৎ বলে পরিচিত ছিল, তাঁরাও জীবনধারণের জন্যে দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করেছে।” ওই দুর্ভিক্ষ বাংলার সৎ ও ভদ্র মানুষদেরও অসৎ ও অন্যায় পথে জীবনধারণে প্ররোচিত করেছিল। বাংলার পারিবারিক জীবনেও সেই দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া পড়েছিল। ওই দুর্ভিক্ষের সময়ে
বাংলার পারিবারিক জীবন দ্রুত ভাঙ্গতে শুরু করে দিয়েছিল। নিজের পুত্রকন্যা বিক্রি, স্ত্রী-ত্যাগ ও আত্মবিক্রয়ের মত ঘটনাগুলি দুর্ভিক্ষের বছরগুলিতে অনেক বেড়ে গিয়েছিল। শেষে দাস বিক্রি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, বাজারে বিক্রেতাদের ভিড় থাকলেও সেখানে ক্রেতা বা খরিদ্দার পাওয়া যাচ্ছিল না। “পতিপত্নী পুত্র ছাড়ে পেটের লাগিয়ে” - কথাটি সমকালীন বিপর্যস্ত পারিবারিক তথা মানবিক সম্পর্কের পরিচয় দেয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কোম্পানির শাসনের উপরে দু' রকমের প্রভাব ফেলেছিল - (১) দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান, ও (২) ভূমিরাজস্বের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। প্রথমতঃ, ১৭৭১ সালের ২৯শে আগস্টের চিঠিতে কোম্পানির ডিরেক্টর সভা নায়েব দেওয়ান রেজা খাঁর কার্যাবলীর নিন্দা করে বাংলা থেকে তাঁর শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল, এবং কোম্পানির হাতেই বাংলার ভূমিরাজস্বসহ সমস্ত শাসন ক্ষমতা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। (“to stand forth as Duan, and, by the agency of the Company's servants, to take upon themselves the entire care and management of revenues.) দ্বিতীয়তঃ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার কৃষি অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছিল, সেটা পূরণ করবার জন্য, বিশেষকরে অনাবাদী জমি চাষে আনা এবং বাংলার নব্য ধনীদের জমিতে আকৃষ্ট করবার উদ্দেশ্য নিয়েই ‘লর্ড কর্ণওয়ালিশ’ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন।

(তথ্যসূত্র:

রানা

১- দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়া, ১ম খণ্ড, রমেশচন্দ্র

দত্ত৷

২- ইতিহাসাশ্রিত বাংলা কবিতা, সুপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়। ৩- দি এগ্রেরিয়ান সিস্টেম অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এ. সি.
৩- দি এগ্রেরিয়ান সিস্টেম অব বেঙ্গল, ১ম খণ্ড, এ. সি. ব্যানার্জী।

৪- সিয়ার মুতাক্ষরীণ, ৩য় খণ্ড, গোলাম হোসেন, ইংরেজি অনুবাদ: মঁশিয়ে রেমণ্ড

৫- ফিফথ রিপোর্ট, ১ম খণ্ড, হিস্টোরিক্যাল

ইন্ট্রোডাকশন, ফারমিংগার সম্পাদিত। © রানা চক্রবর্তী©

৬- দি ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ২য় ও ৩য় খণ্ড, এন.

কে. সিংহ।

৭- দি এ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল, উইলিয়ম উইলসন

হান্টার।

৮- ট্রানসাকশনস ইন ইন্ডিয়া, ইয়ংহাজবাণ্ড।

৯- ভারতের কষেক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, ১ম

খণ্ড, সুপ্রকাশ রায় | ১০- হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ২য় ও ৩য় খণ্ড, এন. কে. সিংহ

সম্পাদিত।

১১- কার্টিয়ার, ননীগোপাল চৌধুরী।)
কপি
পেস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রাআত্মহনন করেন, একটি বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই মুহূর্তে সাপ ছোবল মারে তাঁর বুকে।

 সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রাআত্মহনন করেন, একটি বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই মুহূর্তে সাপ ছোবল মারে তাঁর বুকে। ক্লিওপেট্রা ....মিশ...