আমি 'চ' উচ্চারণ করতে পারতাম না।
বাবা লালচোখে তাকিয়ে বলতেন─ "ওটা 'ত' নয় ব্যাটা! ওটা 'চ'।"
বাবা আমাকে বর্ণমালা চিনিয়েছিলেন।
শৈশবে, বিছানা ভেজানোর পর ফুঁপিয়ে কাঁদতাম আমি সারারাত জেগে।
মা আমাকে বকতেন না, তবুও।
বাবাকে ভয় পেতাম আমি।
ভূগোল ক্লাসে পণ্ডিত স্যার প্রশ্ন করেছিলেন─ "দুনিয়ার উচ্চতম পর্বত কোনটা বল দিকিনি?"
আমি হাত তুলেছিলাম, নির্দ্বিধায় বলেছিলাম─ "আমার বাবা।"
আমার বাবার চেয়ে বিশালতর কাউকে আমি স্বীকার করিনি।
সিগারেট ফুঁকতে পারিনি কোনোদিন, বাবার ভয়ে।
বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বলতে পারিনি─ "দোস্তো রে, ওপাড়ার নাঈমা আমাকে ঘুমোতে দেয় না!"
বাবার ভয়ে।
গুনগুনিয়ে রবীন্দ্রনাথ গাইতে গিয়েও গাইতে পারিনি কখনো,
বারবার মনে হতো এই বুঝি বেসুরকে তিরস্কার করছেন বাবা!
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে আমার নামের নিচে লিখা ছিল─
পিতা─ আলী আহমেদ ইঞ্জিনিয়ার;
এর নিচে কী লিখা ছিল পড়ে দেখার সাহস ছিল না আমার,
পড়ে দিয়েছিলেন বাবাই।
মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে গিয়ে, ইচ্ছে করতো ঘিয়ে পাঞ্জাবিটা কিনি আমার বাবাটার জন্য,
কিনতে পারিনি কোনোদিন─
বাবাকে আমি ভয় পেতাম।
আমার জামার সুতোগুলোয় আমার বাবার ঘাম মাখা,
আমার উচ্চারিত বর্ণমালায় আমার বাবার লালচোখ,
আমার ভেঙে যাওয়া ঘুমের পিঠে আমার বাবার শাসন,
আমার কিনতে না-পারা ঘিয়ে পাঞ্জাবিটায় আমার একফোঁটা অশ্রু।
আমার বুকের ভিতরে জগতের বিশালতম পর্বতটার উচ্চতম শিখর আমার বাবার সটান মাথাটি।
এখন আমি রোজ বসে থাকি আমার বাবার পাশে,
বাবা হুইলচেয়ারে বসে তাকিয়ে থাকেন দিগন্তের দিকে।
বাবা আজ কুঁকড়ে থাকেন হুইলচেয়ারের কোমরের কাছে।
বাবাকে এখন আমি কোলে করে উঠোনে নিই, আকাশ দেখাই, শোনাই তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রনাথ─
"অলকে কুসুম না দিয়ো, শুধু শিথিল কবরী বাঁধিয়ো।"...
আমার বাবার গায়ে ঘিয়ে পাঞ্জাবি।
বাবা, আমার উচ্চারিত প্রত্যেকটি শব্দের প্রথম বর্ণটি 'ব';
বাবা, আপনি তো জানেন না, মানুষের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের প্রথম বর্ণটি─ 'ব'।
Salah Uddin Ahmed Jewel
#উচ্চতম_পর্বত, ০১.০৪.২০২০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন