ট্রেনে ফিরছিলাম। গিয়েছিলাম মেয়ের বিয়ের জন্য গয়না কিনতে। সঙ্গে আমার মেয়েও গিয়েছিল। সামনের মাসেই আমার ছোটো মেয়ের বিয়ে। আমার অবশ্য দুই মেয়ে। বড়ো মেয়ের বিয়ে হয়েছে তাও প্রায় সাত বছর হয়ে গেল। বছর দুয়েক হলো আমিও রিটায়ার করেছি। ছোটো মেয়ের ইচ্ছে বিয়ের সমস্ত গয়না কলকাতা থেকে কিনবে, আর আমাকে সঙ্গে যেতে হবে। আমি তবুও বললাম,
-আমি গয়নার কি বুঝি বল তো! তোর মাকে নিয়ে যা।
আমার কথা শুনে ছোটো মেয়ে বলল,
-তোমাকেই যেতে হবে। তুমি বোঝো আর নাই বোঝো আমি কোনো কথা শুনব না।
তবে এ ব্যাপারে আমার বড়ো মেয়ে অনেক আগে থেকেই বলেছিল, বোনের জন্য সমস্ত গয়না কলকাতা থেকেই নিও। তাহলে আমিও যেতে পারব তোমাদের সাথে।
আমার বড়ো মেয়ের বিয়ে হয়েছে বালিগঞ্জে। আমি আর আমার ছোটো মেয়ে তাই আগের দিন সন্ধ্যেয় চলে এসেছিলাম বড়ো মেয়ের বাড়িতে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে দুই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম কেনাকাটা করতে। প্রথমে গড়িয়াহাট গিয়ে বিয়ের বেনারসীটা কেনা হয়, তারপর ওখান থেকে চলে যাই পি. সি.চন্দ্র জুয়েলার্সে। গয়না গাটি কেনাকাটা করে দোকান থেকে যখন বের হলাম তখন সাড়ে আটটা বেজে গেছে। বড় মেয়ে ওর বাড়ির দিকে রওনা দিল। আমি আর ছোটো মেয়ে ওখান থেকে ট্যাক্সি ধরে হাওড়া চলে আসি। হাওড়ায় এসে দেখি ন'টা বিয়াল্লিশের ট্রেনটা বেরিয়ে গেছে। পরের ট্রেন দশটা দশে। ওয়েট করা ছাড়া উপায় নেই। রাত তখন অনেকটাই হয়ে গেছে।
যাইহোক, দশটা দশের ট্রেনটা ধরি। ট্রেনের মাঝামাঝি একটা জেনারেল কামরায় উঠি। যখন ট্রেনে উঠি তখন ভালোই লোকজন ছিল। যাব এক ঘণ্টার বেশি রাস্তা। কর্ড লাইন বর্ধমান লোকাল। আস্তে আস্তে ভীড়টা কমতে লাগল। একটার পর একটা স্টেশন যত আসছে ততই কামরা ফাঁকা হতে লাগলো।অনেক ক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছি কিছুটা দূরে বসে আছে দুটি ছেলে। তার মধ্যে একজনের পেশি বহুল তাকড়াই চেহারা। বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে। গুণ্ডা টাইপের দেখতে। হাতে একটা বালা। মুখে রুমালটা বেঁধে রেখেছে। আমাদের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। এই তাকানোটা আমার ঠিক ভালো ঠেকছিল না।ট্রেনের কামরা যখন ফাঁকা হয়ে গেল, তারপর থেকে ভয়টা আরো বেশি করতে লাগলো। ওদের তাকানো দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল। গয়নার ব্যাগটা আমি কোলের ওপর রেখে চেপে ধরে বসে আছি। মনে মনে আমি সাহস দেখানোর চেষ্টা করছি। ওদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমি ভয় পাই না। এদিকে আমার মেয়েও পাশে বসে আছে। আমার মেয়েও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমাকে ফিস ফিস করে বলল,
-বাবা খুব একটা ভালো দেখছি না। ভয় করছে ভীষণ। দিদির কথা শুনলেই ভালো হত। দিদি আজকের দিনটা থেকে যেতে বলেছিল, আর তুমি শুনলে না। চলো পরের কামরায় চলে যাই।এই কামরাতে একটাও লোক নেই।প্রাণে বাঁচতে পারব না না'হলে।
মেয়েকে ভরসা দিয়ে বললাম,
-তাই করতে হবে। পরের স্টেশনটা আসতে দে, ভয় পাস না। মনে সাহস রাখ।
হঠাৎ করেই ট্রেনটা সিগন্যাল না পেয়ে মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল।ধূ ধূ মাঠ। কেউ কোত্থাও নেই। চারিদিক অন্ধকার। এদিকে আমার কাছে দশ লাখ টাকার মতো গয়না, বিয়ের দামী দামী শাড়ি, মনের ভিতর যে কি হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না।
তারপর দেখি ওই দুটি ছেলের মধ্যে ওই মোটাসোটা চেহারার ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকেই তখন এগিয়ে আসছে।আমাদের কামরায় একটা লোকও নেই যে আমাদের সাহায্য করতে পারে। আমার মেয়ে ততক্ষণে ভয়ে জড়ো হয়ে আমার গা ঘেঁষে এসে বসেছে। চিৎকার করব না কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। যা হবে হবে, মনে সাহসটুকু রেখেছি। তারপর ছেলেটি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে আমার পা দুটো ছুঁয়ে প্রণাম করে বলে,
-স্যার চিনতে পারছেন?
স্যার বলতেই তো আমি অবাক। আমি তখন মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।
-স্যার চিনতে পারছেন না? আসলে না চিনতে পারারই কথা।আজ কত দিন হলো স্কুল ছেড়েছি। আমাদের মনে রাখার মতো কোনো বৈশিষ্ট্যই তো নেই। তবে স্যার একটু মনে করুন আমাকে চিনতে পারবেন হয়তো। আমার ডাক নাম গদাই। আপনি গদা বলে ডাকতেন।
-গদা? গদা মানে তুই সেই গদাই। দেখেছো কি কাণ্ড। একদম চিনতে পারিনি।
-আমি স্যার আপনাকে দেখেই চিনতে পেরেছি। তখন অনেক লোকজন ছিল বলে কাছে আসতে পারিনি। আপনাকে কি করে ভুলি স্যার। স্যার মনে আছে আমি একটা খুব খারাপ কাজ করেছিলাম। দীনুর ব্যাগ থেকে একদিন দশটাকা চুরি করেছিলাম। আমি চুরি করেছি এটা জেনেও সবার সামনে আপনি আমার নামটা বলে দেন নি। পরে আমাকে আলাদা করে ডেকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমি ওই কাজটা ঠিক করিনি।আমাকে শুধরে দিয়েছিলেন। আপনি সৎ হতে শিখিয়েছিলেন।মানুষ হতে বলেছিলেন। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম না। তাই লেখা পড়া বেশি দূর এগোয় নি। কিন্তু সেদিন আপনার সেই শিক্ষা ভুলিনি।
গদাইয়ের কথা গুলো শুনতে শুনতে সেই কুড়ি বছর আগে স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের মুখ গুলো যেন আবার একবার মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল গদাই ঠিকই বলছে। চেহারাটা ভালো ছিল বলে আমি ওকে গদা বলতাম। গদা নামটা শুনে ও নিজে ফিকফিক করে হাসত তখন। সেদিনের সেই গদাই আজ কত বড়ো। অথচ আমি চিনতে পারিনি। আমি নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম,
-কি করছিস এখন?
-স্যার একটা মারুতি ভ্যান কিনেছি। এখন ওই গাড়িটাই চালাই।
-বিয়ে করেছিস তো?
-না স্যার। বিয়ে করিনি। স্কুল ছাড়ার বছর তিনেক পর আমার বাবাও মারা গেল। আমার দুই বোন। আমি নিজে বোনেদের বিয়ে দিয়েছি। আর আপনি তো জানেন আমার মা যখন মারা গেল আমি তখন সিক্সে পড়ি। তারপর তো বাবা আবার বিয়ে করল।
সত্যিই তো গদাইয়ের মা ছোটো বেলায় মারা গিয়েছিল। আরো সব কিছু যেন ছবির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। কত দিনের কথা আজ সব মনে পড়ে গেল।
-তাহলে এখন বাড়িতে কে কে আছেন?
-আমি আর আমার মা। জানেন স্যার কখনো মনে হয়নি উনি আমার সৎ মা। আমাকে খুব ভালো বাসে। আমি যত রাতেই বাড়ি ফিরি আমার জন্য জেগে বসে থাকবে। আমি বারণ করি কিন্তু শুনবেই না। বলে তুই ছাড়া আমার কে আছে? আমিও আমার মাকে খুব ভালোবাসি। পরের মাসে মাকে নিয়ে হরিদ্বার যাচ্ছি। আপনারাও চলুন না আমাদের সাথে!
-হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাব। আমার ছাত্র বলছে যখন তখন তো যেতেই হবে।
দূর থেকে মানুষকে দেখে অনেক কিছু ভুলভাল চিন্তা করে ফেলি। তারপর ভাবনা গুলো এলোমেলো হয়ে যায়। গদাই ফার্স্ট ,সেকেণ্ড, থার্ড কখনো হতে পারেনি, এক থেকে দশের মধ্যেও আসতে পারেনি। তার দায়িত্ব বোধ, কর্তব্য বোধ,শ্রদ্ধা, সম্মান, মায়ের প্রতি ভালোবাসায় প্রথম সারির অনেক ছেলেকেই ফেলে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়েছে। সব শিক্ষা কি বইয়ের পাতায় থাকে? জীবনের পাতায় অনেক শিক্ষা লুকিয়ে থাকে। কথা গুলো মনে মনে ভাবতে থাকি। এদিকে স্টেশন চলে আসতে দেখে গদাই বলল,
-স্যার নামবেন তো?
সংবিৎ ফিরল গদাইয়ের কথায়। 'এক্ষুণি চলে এলাম। তোর সাথে কথা বলতে বলতে বুঝতেই পারিনি সময় কীভাবে কেটে গেল।'
-স্যার ভারী ব্যাগটা আমার হাতে দিন। আমি নিচ্ছি ওটা।
ট্রেন থেকে নামি। বাড়ি আট-দশ মিনিটের হাঁটা পথ। তো হেঁটেই চলে যাব আমরা। গদাই বলল,
-স্যার দু মিনিট দাঁড়ান। স্টেশনের কাছেই আমার গাড়ি রাখা আছে আমি বাড়ি পৌঁছে দেব আপনাদের।
-না না হেঁটেই চলে যাব।
-না স্যার আমার গাড়ি থাকতে হাঁটবেন কেন?
ভয় ভীতি দূরে সরে গিয়ে মনের ভিতর এক অন্য রকম আনন্দ হচ্ছে তখন। তারপর গদাই বাড়ি পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিল।বাড়িতে ভিতরে আসার কথা বলতে গদাই বলল,
-স্যার বাড়ি তো দেখে গেলাম। পরে একদিন আসব।
গদাই গাড়িতে স্টার্ট দিতে শুরু করেছে, ঠিক সে সময়েই আমার ছোটো মেয়ে বলল,
-দাদা একটু দাঁড়াও।
তারপর বাড়ির ভিতর থেকে বিয়ের কার্ডটা নিয়ে এসে গদাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-বিয়ের দিন সকাল থেকেই চলে এসো, আর কাকিমাকে সঙ্গে নিয়েই এসো। তোমার মতো আমার একটা দাদা থাকলে আমার আর চিন্তা কি। আজ থেকে তুমি আমার দাদা।
দাদা ডাক শুনে গদাই যে কতটা খুশী, সেই খুশীর ছাপ ফুটে উঠল গদাইয়ের চোখে মুখে। গদাই হাসি মুখে বলল,
-নিশ্চয়ই আসব। বোনের বিয়ে বলে কথা। জীবনে এও এক অনেক বড়ো পাওয়া, এমন সৌভাগ্য কত জনের হয়!
পড়াশোনায় হয়তো গদাই ভালো ছিল না। জীবনাচরণের শিক্ষায় সে শিক্ষিত। এমন কতো গদাই আছে তারা আজও শ্রদ্ধায় সম্মানে মাস্টারমশাই দিদিমণিদের অন্তর ভরিয়ে দিয়ে ভিতরটাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। ভালো লাগায় নয়, ভালোবাসায় মনটা ভরে যায়। আমরা হয়তো ছাত্র ছাত্রীদের সব সময় চিনতে পারি না। ছাত্র ছাত্রীরা কখনো ভুলে যায় না স্যার ম্যাডামদের। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে গদাই। সম্মানের আলাদা একটা সুবাস তো আছেই, তাতেই আজীবন ভরে থাকা যায়। মাস্টারমশাইদের জীবনে এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি।
-:সমাপ্ত:-
(রিপোস্ট)
গল্প: প্রাপ্তি
কলমে: সরজিৎ ঘোষ Sarajit Ghosh
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন