প্রাইমারি স্কুলটার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন গৌরী দেবী। ৩২-৩৩ বছর আগে যখন নতুন বউ হয়ে এই গাঁয়ে আসেন তখন এখানেই গ্রামের মানুষ তাসা, ব্যান্ড পার্টি নিয়ে নেচে-গেয়ে প্রায় এক ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছিল। প্রথম দিন এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা খুব কম মেয়ের কপালেই জোটে।
পরে গৌরী দেবী জেনেছিলেন, সমস্ত ব্যবস্থাই করে রেখেছিল তাপসের বন্ধু হাফিজুল। শিলিগুড়িতে একসঙ্গে বি.টেক পড়তো ওরা। হাফিজুলের বাড়ি উত্তরবঙ্গের রাজা ভাত খাওয়ায়। অসম্ভব বড়লোকের ছেলে।
স্কুল মাঠের মাঝখানে একজন মাস্টারমশাই চেয়ারে বসে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। বাচ্চারা প্রায় মৌমাছির মত ঘিরে ধরেছে শিক্ষককে। কয়েকজন দুষ্টু ছেলে স্যারকে কেন্দ্র করে গোল হয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
গৌরী দেবীকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাস্টার মশাই উঠে এলেন। কাছে এসে আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না! কার বাড়ি যাবেন?
ভালো করে দেখলেন ছেলেটিকে গৌরী দেবী। প্রায় বছর চারেক কাটিয়েছিলেন এখানে। এখানকার অনেকেই তখন চিনে ফেলেছিলেন। ভেবেছিলেন হয়তো এখনও চিনতে পারবেন। কিন্তু না। এরা ইয়াং জেনারেশন। ২৮-৩০ বছরের যুবক। ঠিক চিনতে পারলেন না।
মাস্টারমশাই এর প্রশ্নের উত্তর চট করে দিতে পারলেন না গৌরী দেবী। মুখ ফুটে বলতে পারলেন না কার বাড়ি যাবেন। তাপস বাবুর বাড়ি যাবেন এটা বলতে কেমন বাঁধো বাঁধো ঠেকলো। তাপসকে আর তার দু'বছরের ছেলে তনুময়কে ফেলে যে অবস্থায় ডিভোর্স নিয়ে সে জার্মানি চলে গেছিল সেটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ছিল তখন।
প্রায় কুড়ি বছর কাটিয়ে প্রচুর পয়সা নিয়ে যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন তিনি তার সমস্ত আপনজনকে হারিয়েছেন। মা গত। ছোটবেলা থেকেই বাবা নেই। এক পিসি ছিলেন তিনিও মারা গেছেন।
এই জার্মানি যাওয়া তার নিজের মা ও তখন সাপোর্ট করেননি। তিনি রেগে বলেছিলেন, এত বড়ো ঘরে তোর বিয়ে দিলাম। জামাই কলেজে পড়ায়। এরপরে আর কি লাগে! বাচ্চাটার কথা তো ভাবতে হবে নাকি! তখন গৌরী কারো কথাই কানে তোলেনি, মায়ের কথাও না। ফলে রেগে তিনি আর মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি।
সে সময় গৌরীরও অত্যন্ত অভিমান হয়েছিল। অনেক কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়ে বিদেশে পি.এইচ.ডি করার সুযোগ পেয়েছিল সে। শুধু সুযোগ নয়, লাখ টাকার উপর মাসে মাসে দেবেন তারা। এমন সুযোগ সে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায়নি। এমন সুযোগ জীবনে চট করে আসেও না। নিজস্ব আইডেনটিটি কে না তৈরি করতে চায়!
তাপস যখন প্রথম কথাটা শোনে তখন বলেছিল, মাত্র দু'বছরের ছেলে!
তখন গৌরী কোন কিছুই শোনেনি। তাপসকে ডিভোর্স দিয়ে ছেলে ফেলে মাকে কাঁদিয়ে সে জার্মানি চলে যায়। প্রতিজ্ঞা করে যায় কোনদিন সে দেশে ফিরবে না। কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না। মরে গেলেও না।
কিন্তু রিটায়ার এর পর সমস্ত কাজকর্ম ফুরিয়ে গেলে জার্মানিতেই একদম একা হয়ে যান গৌরী দেবী। তখনই তার মনে পড়ে দেশের কথা। ছেলের কথা।
ফিরে এসে নিউ টাউনে কোটি টাকার ফ্ল্যাটও কেনেন। সন্ধ্যে হলেই নিয়ম করে সিটি সেন্টারে যান। মানুষজন দেখেন। কোলাহল শোনেন অগনিত লোকের।
কিন্তু একাকীত্ব বড় ভয়ংকর। নিজেকেই নিজের কাছে শত্রু করে তোলে। একটা সময় মারাত্মক ভয় চেপে বসে বুকে। হতাশা গ্রাস করে। মৃত্যু ভয় ঘিরে ধরে। সামান্য একটা সাহায্যের হাত তখন ভীষণ দরকার। মনে হয় টাকা নয়, পাশে মানুষ দরকার, একান্ত আপনজন দরকার।
তিনি যেদিন প্রথম ভাবেন ঝামালডাঙ্গা, তাপস, ছেলেকে একবার দেখতে যাবেন, লুকিয়ে হলেও নিজের ছেলেকে দেখতে যাবেন, নিজের বরকে দেখতে যাবেন সেদিন ভেতরে ভেতরে খুব আনন্দ হয়েছিল। এক্সাইটেড ছিলেন ক'দিন।
কিন্তু আজ যখন সেই প্রাইমারি স্কুলের কাছে এসে দাঁড়ালেন তখন যেন পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা তাকে ঘিরে ধরল। নিজেকে অপরাধী মনে হল।
মাস্টার মশাই আবার জিজ্ঞেস করল, কোথা থেকে এসেছেন? কার বাড়ি যাবেন?
গৌরীদেবী যেন চমকে উঠলেন। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আমি রেডক্রস কর্মী, এখানে তাপসবাবু বলে এক প্রফেসর থাকেন। উনার বাড়ি।
ছেলেটি আর কোন বাক্য ব্যয় না করে তর্জনী উঁচু করে মাঠের পাশে দোতলা বাড়িটি দেখিয়ে দিয়ে বলল, উনি তো বেঁচে নেই! যান।
তাপস নেই! কথাটা শুনে বুকের ভেতরটা কেমন দুমড়ে-মুচরে উঠল।
গৌরীদেবী বাড়ির লোকেশনটি জানতেন। তখন একতলা ছিল। দোতলা দেখে তার সন্দেহ হয়েছিল। এখন কনফার্ম হলেন।
যা হয় হবে ভেবে গৌরীদেবী মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বাড়িটিতে প্রবেশ করলেন। উঠুনের মাঝে এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন চারিদিকে তাকিয়ে।
এমন সময় একটি টুকটুকে সুন্দরী বউ দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
গৌরীদেবী ভালো করে দেখলেন বউটিকে। তারপর বললেন, তুমি বুঝি এ বাড়ির বউ! আমি রেডক্রস থেকে এসেছি। আশেপাশের কোন অভুক্ত পরিবার আছে কিনা সমীক্ষা করতে। ভাবলাম তোমরা সাহায্য করতে পারবে।
বউটি ফুরুত করে দৌড়ে গিয়ে একটি চেয়ার এনে বসতে দিয়ে বলল, বসুন।
গৌরীদেবী ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না বসবো না। আমার সময় নেই। আরো কয়েকটি গ্রামে যেতে হবে। বলেই ফিরে দাঁড়ালেন।
এবার বউটি অনুরোধ করে বলল, একটু দাঁড়ান, বলেই আবার ফুরুত করে দৌড়ে চলে গেল ঘরের মধ্যে।
অনেকক্ষণ পর হাতে একটি সিঁদুরের কৌটো নিয়ে ফিরে এসে দুঃখিত হয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না। দাদাবাবু একটু আগে ফোন করেছিলেন। বাড়িতে কেউ নেই। বৌদি বাপের বাড়ি গেছে। আপনাকে এই সিঁদুরের কৌটোটি দিতে বললেন। আর আপনাকে এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতেও বারণ করেছেন। বলেই বউটি আবার ঝড়ের বেগে দৌড়ে ঢুকে গেল ঘরে।
গৌরীদেবী বিনা বাক্য ব্যয়ে কৌটোটি হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলেন। দেখলেন, এটি তার শাশুড়ি দিয়েছিলেন তাকে।
গৌরীদেবী মারাত্মক অবাক হলেন। তাহলে ঐ মাস্টারমশাই কে? তারই ছেলে! তমাল! চিনে ফেলেছে তাকে!
লজ্জায় দ্রুতপায়ে পথে এসে দাঁড়ালেন গৌরীদেবী। মনে পড়ে প্রথম যখন আসেন কতো লোক ছিল তখন! শ্বাশুড়ি-শশুর কি সুন্দর সেজে গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিল এখানেই। এখানেই তাপস বলেছিল, এই দেখো আমাদের বাড়ি।
অনেকটা পথ এগিয়ে ছিলেন। হঠাৎ শুনুন, এই শব্দটি শুনে পিছন ফিরে তাকাতেই গৌরীদেবী দেখলেন, বাড়ির সেই বউটি তার দিকেই দৌড়ে আসছে আবার।
কাছে এসে বৌটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমার নাম অপলা। আপনার বৌমা! মিথ্যে বলার জন্য আমায় ক্ষমা করবেন। আমি কোনদিন কাউকে মিথ্যে বলিনি। আপনার ছেলের জন্য বলতে বাধ্য হয়েছি।
আপনার ছেলে কথাটা শুনে গৌরীদেবীর বুকের মধ্যে কে যেন হঠাৎ হাতুড়ি দিয়ে সজরে আঘাত করে গেল। বন্যার জলের মতো চারিদিক থেকে ধেয়ে আসতে লাগল চোখের কোন বেয়ে জল।
গৌরীদেবী অপলাকে পিছে ফেলে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলেন আবার। টপ টপ করে পড়তে লাগলো গাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল।
এবার অপলা, দৌড়ে এসে সামনে দু'হাত তুলে দাঁড়িয়ে বলল, একটু দাঁড়ান মা!
গৌরীদেবী চোখ বুঁজে থমকে দাঁড়ালেন। দীর্ঘদিন পর তিনি মা ডাক শুনলেন। ঝরঝর করে চোখের জল ঝরে বুক ভিজে গেল তার।
অপলা রাস্তার উপরেই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে দু'পায়ে হাত রেখে প্রণাম করে বলল, আপনার ছেলেকে দূর থেকে একবার আশীর্বাদ করে যান। ও শুধু সারাদিন মা মা করে। একবার। শুধু একবার।
সোনার সিঁদুরের কৌটো
#বাবুরাম_মন্ডল ✍🏻
#foryourpage
#100k
#highlight
#post
#fbpost
#সংগৃহীত
#dreamfullife
#followerseveryone
#viralpost2025
#everyoneシ゚
#viralreels
#অনুগল্প
#everyone
সংগৃহীত